Home » » যে আসরে বন্ধু মায়েরা শুভা জিনিয়া চৌধুরী |

যে আসরে বন্ধু মায়েরা শুভা জিনিয়া চৌধুরী |

Written By Unknown on শুক্রবার, ৬ মার্চ, ২০১৫ | ১০:২৬ PM

যে আসরে বন্ধু
মায়েরা
শুভা জিনিয়া চৌধুরী | ০৭
মার্চ, ২০১৫
ঢং ঢং করে ঘণ্টা পড়ে। স্কুলের
মূল ফটক বন্ধ হয়ে যায়।
সন্তানদের
নিয়ে আসা অভিভাবকদের ভিড়
কমতে শুরু করে। কেউ দ্রুত
পায়ে বাড়ির দিকে পা চালান।
কেউ ছোটেন অফিসে। কিছু
মায়েদের মধ্যে তেমন
তাড়া দেখা যায় না। তাঁদের
অনেকের বাড়ি দূরে। রাস্তায়
যানজটের
কারণে যাতায়াতে সময়
চলে যায়। তাই স্কুলের
পাশে কোথাও বসে থাকাটাই
ভালো। কেউবা নাড়ির
টানে সন্তানের কাছাকাছিই
থেকে স্বস্তি বোধ করেন। এসব
মায়েরা ছোট ছোট
দলে ছড়িয়ে পড়েন আশপাশে।
চলে তাঁদের গল্প, নানা কথা।
মায়ে মায়ে এই এক বন্ধুত্ব।
হরতাল-অবরোধের
কারণে রাজধানীর বেশির ভাগ
স্কুলে এখন শুক্র ও শনিবার
ক্লাস চলছে। এক শুক্রবার
সকালে রাজধানীর
একটি বেসরকারি স্কুল
ঘুরে দেখা মিলল এসব মায়ের।
ছোট ছোট দলে মায়েরা গল্প
করছেন। কলেজ
বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন
বন্ধুদের আলাদা আলাদা দল
থাকে। তাঁদের গল্প,
কথা থেকে মায়েদের এই জগতের
কিছুটা খোঁজ মেলে। এ
সময়টুকুতে সন্তানের
লেখাপড়া, নিজেদের সুখ-দুঃখ
পরস্পরের সঙ্গে ভাগ করে নেন
তাঁরা। সংসারের
হাজারো ঝক্কির মধ্যে এই
সময়টুকু তাঁদের এক ধরনের
বিনোদনও দেয়।
অভিভাবকদের
মধ্যে বন্ধুত্বে বাবাদের
চেয়ে সন্তানের মায়েদের
দলটিই বেশি সক্রিয়।
ছেলে বা মেয়ের পড়াশোনার
খোঁজখবর, সিলেবাস সবই
তাঁরা অন্য ভাবিদের কাছ
থেকে সংগ্রহ করতে ব্যস্ত
থাকেন। এখানে কোনো মা নিজের
নামে পরিচিত নন। কেউ আদৃতার
আম্মু, কেউ দৃষ্টির আম্মু, কেউ
রামিসার আম্মু, কেউ আবার
শুভ্রের আম্মু।
একে অপরকে ‘ভাবি’ সম্বোধন
করলেও ‘আদৃতার আম্মু’
বা ‘শ্রেষ্ঠির আম্মু’ বলেই
পরিচিত তাঁরা।
মুঠোফোনে নামটাও সংরক্ষণ
করা থাকে ওই নামেই।
এখানে তাঁরা শুধুই মা। তাঁদের
আর কোনো পরিচয় নেই। নেই
নিজের নামও।
স্কুলের সামনেই একটি ফটোকপির
দোকান। সেখানে মায়েদের
লম্বা লাইন। সবার হাতে সিলেবাস
ও প্রশ্ন। সবই গত বছরের।
সেগুলো সংগ্রহ করে সন্তানের
পড়াশোনা এগিয়ে রাখতে চান
মায়েরা। লাইনে সবার
সামনে দাঁড়ানো দৃষ্টির
মাকে প্রশ্ন ও সিলেবাস
দিচ্ছিলেন অন্যরা। তিনিও
হাসিমুখে সব নিচ্ছিলেন। ‘ভাবি,
আমার জন্য একটা করবেন’, ‘আমার
জন্য একটা’,‘আমি তিথির আম্মু,
আমার জন্যও কিন্তু করবেন’।
দৃষ্টির মা এবার একটু হিমশিম
খেয়ে যান।
পাশে দাঁড়ানো বাবাদের
দলটি কিছুটা বিব্রত। একটু
সাবধানে তাঁরা দৃষ্টির
মাকে বলেন, ‘ভাবি, আমরাও আছি।
আমাদের জন্যও করবেন।’ দৃষ্টির
মা একপর্যায়ে বলেন, ‘সবাই হাত
তোলেন। কে কে নেবেন?’
বলতে গিয়ে তিনি নিজেও
হেসে ফেলেন। মা, বাবারাও
হাসতে হাসতেই হাত তোলেন।
অনেকে বলেন,
‘ছেলেমেয়েরা নয়, আমরাই এখন
ছাত্রছাত্রী।’
ফটোকপি করা সিলেবাস নিয়ে এক
মাকে খুব চিন্তিত দেখা গেল।
এত বড় সিলেবাস
নার্সারিতে পড়া মেয়েকে ক
তিনি। পাশে দাঁড়ানো এক
ভাবি একসময় বাচ্চাদের
স্কুলে পড়াতেন। সন্তানের
প্রয়োজনে চাকরি ছেড়েছেন।
তিনি পরামর্শ দিয়ে আশ্বস্ত
করলেন। রঙিন কাগজ দিয়ে বর্ণ ও
বানান লিখে ঘরের
দেয়ালে টাঙিয়ে রাখার
পরামর্শ দিলেন।
এতে খেলতে খেলতে,
দেখতে দেখতেই শিখবে শিশুটি।
বাড়তি কোনো চাপ পড়বে না ওর
ওপর। শুনে আশ্বস্ত হলেন চিন্তিত
ওই মা।
ফটোকপির দোকানি মহাব্যস্ত। এত
এত ফটোকপি দ্রুত করে চলেছেন
তিনি। ওই দোকানেই চলছে কাপড়
বিক্রি। মায়েরা সেই কাপড়ও
দেখছেন। দোকানটিতে ঢুকলেই
বোঝা যায় এসব মায়েরাই
দোকানের নিয়মিত ক্রেতা।
পাশেই আরেকটি ছোট দোকান।
দোকানটি চালান এক মা ও মেয়ে।
সেখানে স্কুলের বাচ্চাদের
ব্যবহৃত ক্লিপ, ব্যান্ড ও
খেলনা বিক্রি হচ্ছে। হাতের
কাছে পেয়ে চটজলদি প্রয়োজনী
জিনিস কিনে নিচ্ছেন মায়েরা।
আরেকটু
সামনে এগোতে দেখা গেল
একটি ফ্ল্যাট বাড়ির সামনের
জায়গায় গোল
হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকজন
মা। কী নিয়ে গল্প করছেন
তাঁরা?
শুনে একটু হতাশ হতে হয়। একজন
ভাবি সদ্য মা হয়েছেন। সম্ভবত
তিনি দ্বিতীয় সন্তানের
মা হলেন। দ্বিতীয় সন্তানটিও
মেয়ে। পাশে দাঁড়ানো এক
ভাবি বলেন,
‘আমি আপনাকে দেখে আগেই
বুঝেছি সন্তানটি মেয়ে হবে।’
অন্তঃসত্ত্বা মাকে দেখেই
তিনি সন্তান
ছেলে না মেয়ে হবে,
তা বুঝতে পারেন
বলে দাবি করেন।
পাশে দাঁড়ানো আরেক
ভাবি বলেন, ‘কী যে বলেন! কত
শুনলাম। আমার মেয়ে হওয়ার
আগে মুরব্বিরা সবাই বলেছিলেন
ছেলে হবে। হলো তো সেই মেয়ে।’
হাসতে হাসতে বললেও কথার
মধ্যে একধরনের আক্ষেপ। অর্থাৎ
মেয়ে সন্তান হওয়ায়
মায়েদের সেই চিরন্তন আক্ষেপ
এখনো রয়েছে।
স্বাস্থ্যসচেতন মায়েরা আবার
এভাবে বসে সময় নষ্ট করতে চান
না। তাঁরা পুরোটা সময় হাঁটেন।
জোরে জোরে হাঁটেন।
প্রাতভ্র৴মণটা সেরে ফেলেন এই
ফাঁকে।
অনেকে এই ফাঁকে সেরে ফেলেন
বাজার। স্কুলের
সামনে বসে সন্তানের জন্য
অপেক্ষা করতে করতেই শাক
বেছে ফেলেন। বাসায়
গিয়ে রান্না করতে হবে তাঁকে
কাজেই সময় নষ্ট করে লাভ কী?
যাঁরা খুব বেশি আড্ডাবাজ নন,
তাঁরা এককোণে বসে বই পড়েন।
একজন মাকে দেখা গেল বেগম
রোকেয়ার বই পড়তে। কেউ পড়েন
পত্রিকা। কেউ বা সেলাইয়ের বই।
অপেক্ষায় থাকা এই
অভিভাবকদের মধ্যে অবশ্য দাদি-
নানিরাও আছেন।
পা ছড়িয়ে বসে তাঁরা আলাপ
করেন। বেশির ভাগ অসুখ নিয়ে।
সখ্য যাঁদের বেশি, তাঁরা আবার
দলবেঁধে ঘুরে আসেন। আজ অমুক
ভাবির বিবাহবার্ষিকী।
অথবা সন্তানের জন্মদিন।
কাছাকাছি কোনো হোটেলে গিয
উপলক্ষে একসঙ্গে নাশতা করে আস
অনেকে নিজের সেলাই
করা বা সংগ্রহ করা জামাকাপড়
বিক্রি করেন অন্য ভাবিদের
কাছে।
আবার ঢং ঢং। স্কুলের ছুটি।
মায়েরা ছুটে যান মূল ফটকের
সামনে। দ্রুত সন্তানকে নিজের
কাছে নিয়ে আসেন।
চলে যাওয়ার সময়
একে অন্যকে হাসিমুখে বলেন,
‘আসি ভাবি, কাল আবার
দেখা হবে।’

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন