ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজানাথ
সিং সম্প্রতি বাংলাদেশীদের
গরু খাওয়া থেকে বিরত রাখতে এক
মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সম্প্রতি
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে
একটি ভাসমান চৌকি
পরিদর্শনকালে তিনি বলেছেন, গরু
পাচার বন্ধ করে বাংলাদেশীদের
গরুর মাংস খাওয়া থেকে বঞ্চিত
রাখলে সে দেশে গরুর মাংস
খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। ভারতীয়
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এহেন
পররাষ্ট্রবিষয়ক নীতির সংবাদটি
উভয় দেশের পত্রপত্রিকায় ফলাও
করে প্রকাশিত হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়কে অসংখ্য
ধন্যবাদ। তার নীতি অব্যাহত
থাকলে বাংলাদেশের মানুষ
অচিরেই তৃণভোজী গরু বাদ দিয়ে
নিজেরাই তৃণভোজী হয়ে যাবে।
ব্যক্তিগতভাবে গরুর ব্যাপারে
আমার একটি মর্মপীড়াদায়ক স্মৃতি
আছে। স্কুলে পড়ার সময় আমাদের
ষাণ্মাসিক পরীক্ষায় বাংলা
রচনা এসেছিল ‘গরু’। বাংলা
শিক্ষক ছিলেন অত্যন্ত দুর্মুখ একজন।
তিনি গাধা বলে সর্বদাই
আমাদের সম্বোধন করতেন। গরু বিষয়ক
রচনা লিখতে গিয়ে আমি
লিখেছিলাম ‘গরু অতিশয় উপকারী
জন্তু। উহার চামড়া দিয়া জুতা
তৈরি করা যায় এবং গরুর দুধ হইতে
মিষ্টান্ন তৈরি হয়। অতীব দুঃখের
বিষয়, আমাদের বাংলা শিক্ষক
আমাদেরকে গরু না বলিয়া গাধা
বলেন। আমাদেরকে গরুর ন্যায়
উপকারী জন্তুরূপে আখ্যায়িত করা
হইলে সম্মানজনক হইতো।’
বলা বাহুল্য, পরীক্ষার খাতাটি
হাতে করে একদিন তিনি আমাকে
ক্লাসে দাঁড় করিয়ে বললেন, এই যে
গাধা, সম্মান চাস! তোকে
সম্মানার্জনী দিয়ে সম্মান করা
হবে। তোর ভাগ্য ভাল যে, অফিসে
কোনো ঝাঁটা পেলাম না। তার
বদলে বেত নিয়ে এসেছি।
পরীক্ষার খাতায় আমার কথা তুলে
আমাকে অপমান!
এরপর কি ঘটনা ঘটেছিল, তা আর
কহতব্য নয়।
আমাকে নিবিষ্টচিত্তে পত্রিকা
পড়তে দেখে চাচা বললেন, কি
পড়ছো?
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা।
তিনি বলেছেন, সীমান্ত দিয়ে গরু
পাচার বন্ধ করে বাংলাদেশের
মানুষকে গরু খাওয়া ভুলিয়ে
দিতে। এছাড়া মন্ত্রী বলেছেন,
তার সরকার ভারতজুড়ে গরু জবাই
নিষিদ্ধ করতে জনমত গড়ে তুলবে।
চাচা বললেন, তার আসল খবর কিন্তু
ওটা নয়।
আসল খবরটা কি?
চাচা জানালেন, বাংলাদেশ-
ভারত সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র
ব্যবহারের পক্ষে রাজানাথ সিং
বলেন, ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার
করা যাবে না এমন কোন বিষয় নেই।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো
আমাদের সীমান্ত সুরক্ষিত রাখতে
হবে। এমন পরিস্থিতি আমি কখনো
চাইব না, যার ফলে আমাদের
জওয়ানরা হামলার শিকার হয়।
আত্মরক্ষার্থে তারা গুলি
চালাবে না, তা হয় না।’ অবশ্য
একথা বলে বিএসএফ ও বিজিবির
মধ্যে ২০১১ সালে সীমান্তে
প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার
চুক্তিকে অবজ্ঞা করেছেন
রাজানাথ।
আমি জানতে চাইলাম, সরকার
পরিবর্তন হলে কি দুদেশের চুক্তি
বাতিল হয়ে যায়?
আমার কথার উত্তর না দিয়ে চাচা
জানালেন, রাজানাথ আরও
বলেছেন, গত তিন বছরে বিএসএফের
তিনজন জওয়ান নিহত হয়েছে এবং
আহত হয়েছে পাঁচশত। জওয়ানদের
প্রাণের বিনিময়ে
বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখা
যায় না বলে রাজানাথ হুঁশিয়ার
করে দিয়েছেন।
চাচা! গত তিন বছরে কতজন
বাংলাদেশী নাগরিক
বিএসএফের হাতে প্রাণ দিয়েছে,
তার হিসাব কি ভারতের
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আছে? তার
এমন কঠোর কথা বলা উচিত হয়নি।
আমি বললাম।
আমিও সে কথাই বলতে চাচ্ছিলাম।
চাচা জানালেন।
গরুর খবর এখানেই শেষ নয়।
বাংলাদেশে গরু না এলে বছরে
৩১ হাজার কোটি রুপি ক্ষতি হবে
ভারতের। ভারতের ইকোনমিক
টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়,
রাজানাথের নির্দেশ
কঠোরভাবে পালিত হলে বছরে
সোয়া কোটি গরু গোয়ালেই
থেকে যাবে। গরুর গড় আয়ু ১৫ থেকে
২০ বছর। মারা যাওয়ার পাঁচ বছর
আগে দুধ দেয়া বন্ধ হয়ে যায়। ফলে
দুধ না দেয়া সোয়া কোটি গরু
পোষার বার্ষিক খরচ হবে প্রায় ৩২
হাজার কোটি টাকা। চাচাকে
এসব কথা বললাম আমি।
কি ব্যাপার! তুমি আজ হঠাৎ গরু
নিয়ে পড়লে কেন? গরু নিয়ে
কোনো বই লিখছ নাকি?
গরু নিয়ে বই! আমি বললাম, স্কুলে এক
রচনা লিখেই আমি বাংলা
স্যারের বেত্রাঘাত
পেয়েছিলাম। এখন গরু নিয়ে বেশি
কিছু লিখলে আমার কি দশা হবে
কে জানে?
কি বলছ তুমি? গরু লিখলে তোমার
ক্ষতি হতে পারে।
হ্যাঁ, পারে। গরু এখন অতি স্পর্শকাতর
জন্তু।
এর মানে কি? গরুকে স্পর্শ করলে সে
কাতর হয়ে যায়?
না, আমি তা বলছি না। গরু নিয়ে
ভারতে এখন তোলপাড় শুরু হয়েছে।
মানে?
এবারে গরুকে ‘রাষ্ট্রমাতা’
স্বীকৃতি দেয়ার দাবি
জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন
বিজেপি’র এমপি যোগী
আদিত্যনাথ। তিনি পুরো ভারতে
গো-হত্যা নিষিদ্ধ করার দাবি
করেছেন। শুধু তাই নয়, যারা গরুকে
‘রাষ্ট্রমাতা’ হিসেবে তাকে
সমর্থন জানাবেন, তাদেরকে একটি
মোবাইল নম্বরে মিসকল দেয়ারও
আহ্বান জানান তিনি। তাতে
বোঝা যাবে কত লোক তাকে
সমর্থন দিচ্ছে।
চাচা বললেন, ভারতে গরুভক্তি নতুন
নয়। অনেক স্থানে গরুকে পূজা করা
হয়। ধর্মপালনের এই বিষয়টি নিয়ে
কারও বলার কিছু নেই।
আমি তা অস্বীকার করি না। কিন্তু
গরুকে মাতা হিসেবে স্বীকৃতি
দিয়ে সবাই গরুর সন্তান হতে
চাইতে কিনা সন্দেহ। তবে গরু
সম্পর্কিত অনেক চিত্তাকর্ষক তথ্য
আমরা জানতে পেরেছি।
কেমন তথ্য?
মহারাষ্ট্রের মালেগাঁও জেলার
সব গরুর ছবি তুলে রাখার নির্দেশ
দিয়েছেন সহকারী পুলিশ সুপার
মহেশ সাবাই। মালিকদের বলা
হয়েছে, গরুর রেকর্ড রাখার
স্বার্থে তার শনাক্তকরণ চিহ্নগুলো
সম্পর্কে তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করতে
হবে। চিহ্নগুলো হচ্ছে- রঙ, বয়স,
লেজের দৈর্ঘ্য ইত্যাদি। গো-হত্যা
বন্ধে এই রেকর্ড রাখা প্রয়োজন।
মহারাষ্ট্রে গো-হত্যা জামিন
অযোগ্য অপরাধ। অপরাধ প্রমাণিত
হলে ৫ বছরের কারাদণ্ড ও ১০
হাজার রুপি জরিমানার বিধান
আছে।
এসব কথা জানতাম না তো! চাচা
বললেন।
আরও কথা আছে। ক্ষমতাসীন দলের
দুজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গরুর বহুমাত্রিক
ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছেন।
গরু হত্যা না করে বহুমাত্রিক
ব্যবহার? চাচা প্রশ্ন করলেন।
ঠিক তাই। আমি বললাম, একজন
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফিনাইলের বদলে
গরুর মূত্র দিয়ে পরিচ্ছন্নতার কাজ
করার পরামর্শ দিয়েছেন।
সেকি! চাচা বিস্মিত হলেন।
বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। আরেকজন
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অ্যালোপেথিক
ওষুধ ছেড়ে গো-মূত্র ও গোবরের
সমন্বয়ে তৈরি আয়ুর্বেদিক ওষুধকে
সব রোগের প্রতিষেধক বলে দাবি
করেছেন।
এটা সম্ভবত নতুন কিছু নয়। প্রায়শ্চিত্ত
হিসেবে গোবর খাওয়ার বিধান
আগে থেকেই ছিল। তবে মনুষ্য-মূত্রও
স্বাস্থ্যগত কারণে পান করার কথা
জানা যায়।
সেকি! এবার আমার বিস্মিত
হওয়ার পালা।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী
মোরারজি দেশাই নিজের মূত্র
পান করে স্বাস্থ্য রক্ষা করতেন।
চাচা জানালেন।
আমাদের আলোচনার এই পর্যায়ে
চাচি ঘরে ঢুকলেন। বললেন, কি
নিয়ে আলোচনা চলছে।
গরু! চাচা জানান দিলেন।
গরু! চাচি বললেন, আর বলো না। আজ
আমাদের কাজের লোকটা বাজার
থেকে যে মাংস কিনে এনেছে,
তার দাম নিয়েছে একশ’ টাকা
বেশি। এটা কি কোনো কথা হলো?
এক লাফে মাংসের দাম ২৮০
টাকা থেকে ৩৮০ টাকা হতে
পারে? ব্যাটা নির্ঘাৎ ওখান
থেকে ৫০ টাকা সরিয়েছে।
আমার মনে হয় কাজের লোক টাকা
সরায়নি। টাকা সরিয়েছে
ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক।
চাচার মন্তব্য।
মানে?
মানে, ভারতের সঙ্গে আমাদের
পারস্পরিক সম্পর্কের খেসারত
দিচ্ছি আমরা। সেই সম্পর্কের
কারণে গরুর মাংসের কেজি পাঁচশ’
টাকা হলেও আশ্চর্যের কিছু থাকবে
না।
তোমার হঠাৎ এই ভারত বিদ্বেষের
কারণ?
বিদ্বেষ নয়। এটা হচ্ছে ভারত-
প্রেমকথা। সম্পর্ক যত নিবিড় হবে
গরুর মাংসের দাম তত বাড়বে।
হ্যাঁ। ভালো কথা। চাচি আমার
দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ দুপুরে
তুমি আমাদের এখানে খেয়ে
যাবে। গরুর মাংস রান্না করেছি
তো।
আজ ওর এখানে দুপুরের ভোজন হবে
না। চাচা বললেন।
কেন?
গরু নিয়ে আমাদের এত কিছু
আলোচনা হলো, তারপর আর আজ গরুর
মাংস খাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব
নয়।
তুমিও কি তাই বলো? চাচি আমার
মুখের ওপর দৃষ্টি রাখলেন।
ব্যাপারটা তাই। আমি বললাম,
ভারত আমাদেরকে গরু খাওয়া
নিষিদ্ধ করতে বলেনি। কিন্তু এমন
কৌশল এঁটেছে, যাতে আমরা গরু
খাওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হই। তাদের
ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখিয়ে
আমরা না হয় আজকের দিনটা গরুর
কাছ থেকে দূরে সরে থাকলাম।
চাচি উত্তর দিলেন না। সবিস্ময়ে
আমার কথায় কর্ণপাত করে
থাকলেন।
আমি আবার বললাম, চাচি,
আমাদের দেশে গরু ও চতুষ্পদ প্রাণীর
সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তাতে
আমরা অচিরেই গরুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ
হয়ে উঠতে পারি। আমাদের
রাজনীতিতেও গরুর অনুপ্রবেশ
ঠেকানো যাচ্ছে না।
গরু ওআমরা
Written By Unknown on রবিবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৫ | ৮:৫২ AM
Related Articles
If you enjoyed this article just Click here Read Dhumketo ধূমকেতু, or subscribe to receive more great content just like it.
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন