গডফাদারদের সামনে পেছনে
এমপি বদি
এস এম রানা, কক্সবাজার থেকে ফিরে
মানবপাচার চলে মূলত চার ধাপে। শুরু
হয় কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ
উপজেলা দিয়ে। দালালের
দেখানো লোভের ফাঁদে পা দিয়ে
অনেকেই স্বেচ্ছায় চড়ে বসে
ট্রলারে। অনেককে অপহরণের পর
তোলা হয় মানবপাচারের জন্য
অপেক্ষায় থাকা ট্রলারে। যারা
স্বেচ্ছায় যায়, তারা স্থানীয়
দালালদের হাতে আগেই টাকা তুলে
দেয়। কথা থাকে, তাদের
মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দেওয়া হবে।
আর অপহৃতদের প্রত্যেককে প্রথমে ২০
হাজার টাকায় ফিশিং বোটের
মালিক বা নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের
কাছে বিক্রি করে দেয় দালালরা।
একে তারা বলে 'বস্তা বিক্রি'।
পাচারের জন্য বিক্রি করা প্রত্যেক
ব্যক্তিকে 'বস্তা' হিসেবে অভিহিত
করে তারা। মাঝসাগরে সেই
লোকজনকে কিনে নেওয়ার জন্য
অপেক্ষায় থাকে ট্রলার বা অন্য
কোনো সিন্ডিকেট। ফিশিং বোটের
মালিকরা নৌকার লোকজনকে সেই
ট্রলার মালিকদের কাছে কিংবা
সিন্ডিকেটের কাছে বিক্রি করে
দেয়। এভাবে থাইল্যান্ড ও
মালয়েশিয়া পৌঁছা পর্যন্ত দফায়
দফায় মানুষ বিক্রি হয়। এভাবে শেষ
পর্যন্ত মালয়েশিয়া পর্যন্ত নিয়ে
যেতে পাচারকারীরা জনপ্রতি দুই
লাখ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায়
করে। যারা টাকা দিতে পারে না
তাদের সাগরে ফেলে দেওয়া হয়
কিংবা জঙ্গলে নিয়ে হত্যা করা হয়।
বস্তা বিক্রির এই ধাপগুলো
জানালেন উখিয়ার জালিয়াপালং
ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান
আনোয়ার হোসেন চৌধুরী। তাঁর
বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায় পুলিশের
উচ্চ পর্যায়ের অনুসন্ধান কমিটির
প্রতিবেদনেও। গত বছরের ডিসেম্বরে
কমিটি তাদের প্রতিবেদন দিয়েছে।
সেখানেও পাচারের ধাপ ও টাকা
আদায়ের কৌশল সম্পর্কে লেখা
আছে। নগদের পাশাপাশি পাচারের
টাকা লেনদেন হয় বিকাশ, হুন্ডি ও
ব্যাংকের মাধ্যমেও। স্থানীয়
রাজনীতিবিদ ও পুলিশের পকেটেও
যায় সেই টাকার ভাগ।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়,
কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ)
আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুর
রহমান বদির আত্মীয়স্বজন, উখিয়া ও
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের
নেতা এবং পুলিশ সদস্যদের প্রত্যক্ষ ও
পরোক্ষ মদদ কাজে লাগিয়ে
কক্সবাজার থেকে প্রায় প্রতি রাতেই
মালয়েশিয়ায় পাচারের উদ্দেশ্যে
ট্রলারে তোলা হচ্ছে বিপুলসংখ্যক
মানুষ। ২০০০ সাল থেকে প্রকাশ্যে
চলছে মানবপাচার। রোহিঙ্গা
নাগরিক তজর মুল্লুকের দেখানো পথ
ধরে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা ও
বাংলাদেশি স্বেচ্ছায় এবং
অপহরণের শিকার হয়ে সাগরে ভাসতে
থাকা ট্রলারে চড়ে বসে। জলপথে
মানবপাচার খাতে এ পর্যন্ত অন্তত তিন
হাজার ৩০০ কোটি টাকার মুক্তিপণ
লেনদেন হয়েছে। পাচারের শিকার
লোকজনের অনেকেই পথেই মারা
গেছে। কারো সলিল সমাধি হয়েছে,
কারো কারো ঠাঁই হয়েছে
থাইল্যান্ডের গহিন জঙ্গলের গণকবরে।
তবে বরাবরই কক্সবাজার জেলা পুলিশ
ও আওয়ামী লীগ নেতাদের
কৌশলের কারণে আড়ালেই থাকছে
গডফাদাররা। মানবপাচারের পেছনের
মূল হোতা ও তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতার
নাম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী
জানলেও তা গোয়েন্দা
প্রতিবেদনগুলোয় আসছে না। তবে
কালের কণ্ঠ'র অনুসন্ধানে উঠে
এসেছে, এমপি বদির ঘনিষ্ঠজন ও
অনুগতরাই মানবপাচার ও হাজার
কোটি টাকার হুন্ডি ব্যবসার
সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত।
মানবপাচার প্রতিরোধে গঠিত
পুলিশের সেই কমিটির অনুসন্ধানে
উঠে আসা পাচারকারীদের বিষয়ে
খোঁজখবর নিতে গিয়ে সুনির্দিষ্ট এসব
তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধান কমিটির তালিকায়
পাচারকারী হিসেবে টেকনাফ ও
উখিয়া আওয়ামী লীগ-যুবলীগের
অনেক নেতার নাম উঠে এলেও পুলিশ
কৌশলে নামের পাশে তাঁদের
রাজনৈতিক পরিচয় উল্লেখ করেনি।
তবে কালের কণ্ঠ'র অনুসন্ধানে দেখা
যায়, পাচারে সহায়তাকারী
হিসেবে কিংবা পাচারের টাকা
লেনদেনে জড়িতদের বেশির ভাগ
লোকই স্থানীয় আওয়ামী লীগ-
যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
আবার আর্থিক বিষয় জড়িত থাকায়
বিএনপির অনেক স্থানীয় নেতাও
পাচারের সঙ্গে জড়িয়েছেন।
রাজনীতির মাঠে বিরোধিতা
থাকলেও মানবপাচারের ক্ষেত্রে
উভয় পক্ষের নেতারা হাতে হাত
রেখে চলেন।
পুলিশের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের তথ্য
অনুযায়ী ২০১৪ সালে ১৫ থেকে ২০
হাজার লোক অবৈধভাবে সমুদ্রপথে
পাচার হয়েছে। সম্প্রতি
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা
হয়েছে, প্রায় দেড় লাখ মানুষ
অবৈধভাবে যাত্রা করেছে। তাদের
প্রত্যেকের কাছ থেকে দুই লাখ থেকে
দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত
মুক্তিপণ আদায় করে দালালরা।
মুক্তিপণ পাওয়ার পর কিছু মানুষ
মালয়েশিয়া গিয়ে চাকরি
পেয়েছে। সে কথা জানার পর আরো
অনেকে মালয়েশিয়ায় যেতে
স্বেচ্ছায় ট্রলারে উঠেছে। আবার
পাচারকারীরা শত শত সাধারণ
মানুষকে অপহরণের পর বিক্রি করে
দিয়েছে। পরে তাদের পরিবারের
কাছ থেকেও মুক্তিপণ আদায় করা হয়।
প্রতিজনের কাছ থেকে গড়ে দুই লাখ
২০ হাজার টাকা করে দেড় লাখ
মানুষের কাছ থেকে প্রায় তিন
হাজার ৩০০ কোটি টাকা আদায়
করেছে পাচারকারীরা। পুলিশ ও
রাজনৈতিক নেতারা ওই টাকার ভাগ
পান।
গডফাদাররা আড়ালে : উখিয়ার
জালিয়াপালং ইউপির ৩ নম্বর
ওয়ার্ডের সদস্য আবু তাহের ইউনিয়ন
আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে
পরিচিত। যদিও আওয়ামী লীগের
কোনো কমিটিতেই তাঁর নাম নেই।
তাঁর বিরুদ্ধে পাচারকারীদের
সহযোগিতা দেওয়ার অভিযোগ
রয়েছে। তিনি এ বছরের শুরুতে
স্থানীয় বিজিবির ক্যাম্পে হামলার
মামলারও আসামি। তবে আবু তাহের
কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি
মানবপাচার, হুন্ডি ব্যবসা কিংবা
ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নই। এসব
মিথ্যা অভিযোগ।' বিজিবির ক্যাম্পে
হামলা ও মামলার আসামি বিষয়ে
তিনি বলেন, 'আমি বিজিবির
ক্যাম্পে হামলা করিনি, মামলার
আসামিও নই।' যদিও বিজিবি ক্যাম্পে
হামলা মামলার এজাহারে তাঁর নাম
আছে।
পুলিশের অনুসন্ধান কমিটির তালিকায়
পাচারকারী হিসেবে ১০৭ নম্বরে
আছে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন
যুবলীগের সভাপতি আক্তার কামাল
(৩৫)। এ বিষয়ে কথা বলতে তাঁর
মোবাইলে ফোন করা হলেও তিনি
সাড়া দেননি। পরে তাঁর বোনের
স্বামী ও সাবেক শিবির নেতা
ছিদ্দিকুর রহমান এ প্রতিবেদককে ফোন
করেন। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর
তিনি আক্তার কামালকে চেনেন
বলে জানালেও আর কোনো কথা না
বলে ফোন রেখে দেন। তালিকায়
আক্তার কামালের ভাই সাইদ
কামালের নাম আছে ১০৮ নম্বরে।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, টেকনাফ
উপজেলা যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক নূর
হোসেন আক্তার ও সাইদের কাছের
আত্মীয়। তাঁদের চাচা পুলিশ পরিদর্শক
আবদুর রহমান এমপি বদির ছোট বোনের
স্বামী। ফলে প্রশাসনিক ও
রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তাঁরা
এলাকায় দাপটের সঙ্গে অবস্থান
করছেন। পুলিশ পরিদর্শক আবদুর রহমানের
সৎভাই হামিদ হোসেন পাচারকারীর
তালিকায় ১৩৭ নম্বরে আছে।
আক্তার ও সাঈদকে সহযোগিতা
দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নূর
হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তাদের
সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক
আছে। তার মানে এই নয়,
পাচারকারীদের আমরা সহযোগিতা
দিই। আর রাজনৈতিক কারণে আবদুর
রহমান বদির সঙ্গে যোগাযোগ আছে।
কিন্তু মানবপাচার বিষয়ে তিনি
(বদি) কিছুই জানেন না।'
তালিকার ২০৯ নম্বরে আছেন শাহপরীর
দ্বীপের মোহাম্মদ ইসমাইল। ২১০ নম্বরে
আছেন শাহপরীরের দ্বীপের
বাজারপাড়ার ফিরোজ আহম্মদ। উভয়েই
আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের
নেতা হিসেবে পরিচিত।
উখিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা
হিসেবে পরিচিত রেবি আক্তার
ওরফে রেবি ম্যাডাম তালিকার ১৬৪
নম্বরে এবং তাঁর স্বামী নূরুল কবির
তালিকার ১৬২ নম্বরে আছেন। রেবি
গ্রেপ্তারের পর জামিন পেয়েছেন।
যুবলীগের নেতা মাহমুদুল করিম ওরফে
মাদু আছেন তালিকার ১৬৮ নম্বরে।
বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের
মধ্যে তালিকায় রয়েছেন রুস্তম আলী
প্রকাশ রুস্তম মাঝি (১৬৫), বেলাল ওরফে
লাল বেলাল (১৭১), মফিজুর রহমান
মফিজ (১৬৯), মোহাম্মদ সৈয়দ আলম (১৭৩),
নূরুল আবছার (১৬৭), মফিজ ওরফে
মালয়েশিয়া মফিজ (১৭৪), জয়নাল
আবেদীন (১৭৫), যুবদলের নেতা আক্তার
আহমদ ওরফে আক্তার (১৭২), শাহ আলম
(১৭০) ও লালু মাঝি (১৬৬)। তাঁরা
বর্তমানে পলাতক।
হুন্ডি ব্যবসাও আ. লীগ নেতাদের
নিয়ন্ত্রণে : মালয়েশিয়া নিয়ে
যাওয়ার নাম করে মানবপাচারের এ
পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার ৩০০ কোটি
টাকা লেনদেন হয়েছে বলে হিসাব
পাওয়া যায়। পুলিশের অনুসন্ধান
প্রতিবেদন ও কক্সবাজার জেলা
পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে
চার স্তরে টাকা লেনদেনের বিষয়টি
জানা গেছে। কালের কণ্ঠের
অনুসন্ধানে জানা যায়, পুলিশের করা
হুন্ডি ব্যবসায়ীদের তালিকায় সবার
ওপরে আছেন ব্যবসায়ী মং মং সেন,
তিনি এমপি বদির খালাতো ভাই।
ইয়াবা মামলায় মং মংকে
গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। গত ৫
জানুয়ারি তিনি জামিনে ছাড়া
পেয়েছেন। এখন তিনি বান্দরবানের
একজন শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতার
তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম নগরে বাস
করছেন।
তালিকায় ২ নম্বরে আছেন
টেকনাফের ডেইলপাড়ার নূরুল আমিন
(৩৫)। তিনি স্থানীয়ভাবে আওয়ামী
লীগ নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে
চলেন। তাঁর ভাই মো. আমিন ও আবদুল
আমিন পারিবারিকভাবে হুন্ডি
ব্যবসায়ী। তালিকায় ৫ নম্বরে আছে
লামার বাজারের জলিল,
মিয়ানমারের নাগরিক হলেও এখন
তিনি বাংলাদেশের ভোটার।
আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘুষ দিয়ে
এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেছেন।
তাঁর শ্যালিকার জামাই মোহাম্মদ
আমিন বুলু টেকনাফ পৌরসভার
কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা।
মো. আইয়ুব ওরফে বাট্টা আইয়ুবকে বলা
হয় টেকনাফের হুন্ডির রাজা। তিনি
চট্টগ্রাম নগরে থাকেন এবং স্থানীয়
রাজনৈতিক নেতাদের ঘুষ দিয়ে
আধিপত্য বিস্তার করেন। তালিকার ৯
নম্বরে আছেন জাফর আলম ওরফে টিপি
জাফর। তিনি মিয়ানমারকেন্দ্রিক
অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। সম্প্রতি
মিয়ানমারে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের
বৈঠকে তিনি মিয়ানমারকেন্দ্রিক
হুন্ডি ব্যবসার দায়িত্ব নিয়েছেন।
ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের
রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও
বর্তমানে সরাসরি রাজনীতি করেন
না। তবে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে
সুসম্পর্ক রেখে চলেন।
হুন্ডি ব্যবসায়ী হিসেবে
তালিকাভুক্ত আবু বক্কর ও নূরুল আবছার
টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর
মোহাম্মদ আমিন বুলুর ভাতিজা।
চাচার প্রভাবে এলাকায় দাপটের
সঙ্গে চলাফেরা করেন তাঁরা। ইয়াবা
খুলু নামে পরিচিত রশিদ খুলুর মেয়ে
জামাই আবু বক্করের নাম আছে
তালিকার ২১ নম্বরে। রশিদ খুলুর কাছ
থেকে র্যাব চট্টগ্রাম নগরের আছদগঞ্জ
এলাকা থেকে ২০১২ সালে পৌনে
তিন লাখ ইয়াবা জব্দ করেছিল।
হুন্ডি ব্যবসা সম্পর্কে জানতে চাইলে
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের
সাধারণ সম্পাদক ও টেকনাফ
পৌরসভার কাউন্সিলর নূরুল বশর
কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আওয়ামী
লীগের কিছু নেতা
মানবপাচারকারী, হুন্ডি ব্যবসায়ী ও
ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়
দিচ্ছেন, এটা অস্বীকার করা যাবে
না। কারা, কাদের, কিভাবে আশ্রয়-
প্রশ্রয় দিচ্ছে সেটা পুলিশ, কোস্টগার্ড,
বিজিবি ছাড়াও গোয়েন্দা
সংস্থাগুলো জানে। আপনি তাদের
জিজ্ঞেস করুন সব জানতে পারবেন।
আমি নিজের মুখে বলে বিপদে পড়তে
চাই না।' এমপি বদির আত্মীয়স্বজনের
মানবপাচার ও হুন্ডি ব্যবসায়ীদের
প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ বিষয়ে
তিনি বলেন, 'এসব বিষয়ে আমি বক্তব্য
দেব না।'
টাকা লেনদেন ব্যাংকে, বিকাশে,
হুন্ডিতে : পুলিশের অনুসন্ধান
প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী
মানবপাচারের হাজার কোটি টাকা
লেনদেন হয় নগদে, ব্যাংকে, বিকাশে
ও হুন্ডির মাধ্যমে। অনুসন্ধান কমিটির
সদস্য ও কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত
পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমদ এ তথ্য
নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন,
'অনুসন্ধানে ব্যাংকে ও বিকাশের
মাধ্যমে টাকা লেনদেনের বিষয়টি
ধরা পড়লে এ বিষয়ে খুব বেশি
এগোনো সম্ভব হয়নি। কারণ এ ক্ষেত্রে
বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে
ব্যাংকগুলোতে অনুসন্ধান চালাতে
হবে। এটা পুলিশের জন্য কিছুটা কঠিন।'
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,
'এখানকার ব্যাংকগুলোতে কী ধরনের
লেনদেন হচ্ছে, তা এবং অনলাইন
ব্যাংকিংয়ের বিষয়টি গুরুত্বের
সঙ্গে তদন্ত করলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
পাওয়া যেতে পারে। তবে সেটা
করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে।'
হুন্ডি ব্যবসায়ীদের লেনদেনের
কৌশল সম্পর্কে তিনি বলেন, 'হুন্ডি
ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ, মিয়ানমার,
থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াকেন্দ্রিক
ব্যবসা করে। আবার অনেক বৈধ
ব্যবসায়ীও পণ্য আমদানি-রপ্তানির
আড়ালে হুন্ডি ব্যবসা করে।
বাংলাদেশে বসে সিঙ্গাপুরের
ব্যবসায়ীকে টাকা পরিশোধ করার
তথ্যও আছে পুলিশের কাছে। কিন্তু
পুরো প্রক্রিয়াটি হয় মোবাইল ফোনে
এবং বৈধ ব্যবসার আড়ালে। আর বিকাশ
এজেন্ট ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে খুচরা করে
টাকা লেনদেন করা হয় বলে তথ্য
পাওয়া গেছে।'
চার স্তরের আর্থিক
লেনদেনকারীদের আইনের আওতায়
কেন আনা হচ্ছে না- জানতে চাইলে
এসপি শ্যামল কুমার নাথ বলেন, 'অনলাইন
ব্যাংকিং এবং বিকাশের
লেনদেনের তথ্য তদন্ত করার মতো
আধুনিক কোনো সরঞ্জাম পুলিশের
কাছে নেই। বিষয়টি ভালোভাবে
তদন্ত করতে পারে বাংলাদেশ
ব্যাংক।
পুলিশের 'বস্তা গণনা' : ২০১২ সাল
থেকে বেড়েছে মানবপাচার।
একপর্যায়ে এর সঙ্গে রাজনীতিবিদ,
জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ সদস্যরাও
জড়িয়ে পড়েন। অভিযোগ রয়েছে,
তাঁরা 'বস্তা'প্রতি এক হাজার টাকা
করে নিয়ে পাচারের সহযোগিতা
করেন। বছরখানেক আগে উখিয়ার
এয়ারপোর্ট খ্যাত বাদামতলী ঘাট,
রেজুখালের মুখ, উপকূলের ডেইলপাড়া,
পশ্চিম সোনার পাড়া ঝাউবাগান
এলাকায় পুলিশ উপস্থিত থেকে
মানবপাচার করেছে। বস্তাপ্রতি এক
হাজার টাকা আদায়ের অভিযোগ
উঠেছিল ইনানী পুলিশ ফাঁড়ির
তৎকালীন ইনচার্জ সাঈদ মিয়া ও
উপসহকারী পরিদর্শক বোরহানের
বিরুদ্ধে। উখিয়া থানার তৎকালীন
ওসি জাহেদুল কবির ও সাবেক ওসি
অং সা থোয়াইয়ের তত্ত্বাবধানে
মানবপাচার হতো। মানবপাচারের
বিষয়ে সে সময় পুলিশকে তথ্য দেওয়া
হলেও তারা উল্টো তথ্যদাতাকে
হুমকি দিত বলে অভিযোগ করেন
উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়ন
আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ
সম্পাদক ফরিদুল আলম চৌধুরী ও বঙ্গবন্ধু
পরিষদের সদস্য মোস্তাক আহমদ। গত
বুধবার সরেজমিন অনুসন্ধানের সময়
বহুসংখ্যক মানুষ একই অভিযোগ করেন।
মূলত পুলিশের উল্লিখিত সদস্যদের
দায়িত্ব পালনের সময় মানবপাচার
প্রকাশ্যে চলে আসে।
এ বিষয়ে এসপি শ্যামল কুমার নাথ
কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অতীতে
পুলিশের কোনো সদস্য অপকর্মের সঙ্গে
জড়িত ছিল না, এটা জোরগলায় বলতে
পারি না। তবে এখন পুলিশের কোনো
সদস্য অপকর্মের সঙ্গে জড়িত নেই।
পুলিশের কয়েকজন সদস্যদের বিরুদ্ধে এ
ধরনের অভিযোগ পাওয়ার পর তাঁদের
সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।' প্রভাবশালী
রাজনীতিবিদদের বিষয়ে তিনি
বলেন, 'আমি রাজনীতিবিদ ও
জনপ্রতিনিধি সবার সহযোগিতা
নিয়েই মানবপাচার প্রতিরোধে
আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি। পুলিশকে
তাঁরা সহযোগিতা করছেন।'
রাজনৈতিক পরিচয় এড়িয়ে গেছে
পুলিশ : পুলিশের তালিকায় টেকনাফ
ও উখিয়ার যাঁদের নাম আছে তাঁদের
বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ ও
যুবলীগের নেতা। তবে প্রতিবেদনে
পুলিশ কৌশলে পাচারকারী ও হুন্ডি
ব্যবসায়ীদের নামের পাশে তাঁদের
রাজনৈতিক পরিচয় উল্লেখ করেনি।
রাজনৈতিক চাপ এড়াতেই পুলিশ
রাজনৈতিক পরিচয় এড়িয়ে তাঁদের শুধু
মামলার আসামি হিসেবে
তালিকাভুক্ত করেছে। আবার
সরেজমিন অনুসন্ধানে এমন অনেক
পাচারকারীর নাম পাওয়া গেছে,
যাদের নাম তালিকায় নেই।
স্থানীয়রা জানিয়েছে, আওয়ামী
লীগ নেতাদের মধ্যে যাঁরা জড়িত
তাঁরা স্থানীয় এমপি বদির সঙ্গে
যোগাযোগ রাখেন। কিন্তু বদির নাম
তালিকায় নেই। মূলত
রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী
হওয়ার কারণে পুলিশ কৌশলে তা
এড়িয়ে গেছে।
তৃণমূল পর্যায়ে পাচার ও হুন্ডি
ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেকেই আওয়ামী
লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এবং
তারা এমপি বদির অনুসারী- এ বিষয়ে
জানতে চাইলে কক্সবাজারের এসপি
শ্যামল কুমার নাথ কালের কণ্ঠকে
বলেন, 'মানবপাচারকারী ও হুন্ডি
ব্যবসায়ীদের মধ্যে কারো
রাজনৈতিক পরিচয় আছে কি না
জানি না। কারণ কারো রাজনৈতিক
পরিচয় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
তারা অপরাধী, তাদের আইনের
আওতায় আসতে হবে। এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার
আসামিদের কারো জবানবন্দিতেও
রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধির নাম
আসেনি। তাই এ বিষয়ে আমি এখনই
কিছু বলতে পারছি না।'
তবে এসপি স্বীকার না করলেও না
প্রকাশ না করার শর্তে কক্সবাজারে
কর্মরত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা কালের
কণ্ঠ নিশ্চিত করেছেন, রাজনৈতিক
ছত্রচ্ছায়ায় মানবপাচার ও হুন্ডি ব্যবসা
চলছে। তৃণমূল পর্যায়ে যারা এসব করছে,
তারা স্থানীয় সংসদ সদস্য বদির
অনুসারী।
পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা
বলেছেন, 'জনপ্রতিনিধি ও
রাজনীতিবিদরাই এসব অপকর্মের সঙ্গে
জড়িত। আপনারা তৃণমূল নেতাদের
বিষয়ে অনুসন্ধান করছেন, শিকড়ের
দিকে কেউ যাওয়ার সাহস পাচ্ছে
না।'
তবে অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে
এমপি বদির মোবাইল ফোনে
একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও
ওপাশ থেকে কেউ ফোন ধরেনি।
চলছে 'ক্রসফায়ার' কৌশল : ২০০০ সাল
থেকে ব্যাপক হারে মানবপাচার শুরুর
পর গত ১৫ বছরে অনেক মামলা হয়েছে।
গ্রেপ্তারও হয়েছে অনেকে। তবে এত
দিন বিষয়টি পুলিশের কাছে গা
সওয়া বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু
থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবর
আবিষ্কারের পর সরকারের
উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনায় হঠাৎ সরব
হয়ে ওঠে পুলিশ। এরপর চলতি মাসে এ
পর্যন্ত পাঁচজন সন্দেহভাজন
মানবপাচারকারীকে 'ক্রসফায়ারে'
দেওয়া হয়। তাঁরা হলেন- টেকনাফের
দেলু হোসেন, জাফর আলম, মোহাম্মদ
জাহাঙ্গীর, উখিয়ার জাফর আলম
ওরফে জাফর মাঝি ও কক্সবাজার
সদরের বেলাল হোসেন।
ক্রসফায়ার বিষয়ে এসপি শ্যামল কুমার
নাথ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পুলিশ
কাউকে হত্যা করে না। তবে আসামি
ধরতে গিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করলে
পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়ে
থাকে।' দীর্ঘদিন পুলিশ নীরব ছিল- এমন
অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন,
২০১২ থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত
কক্সবাজার জেলার থানাগুলোতে
মানবপাচার-সংক্রান্ত ৩০৬টি মামলা
হয়েছে। অধিকাংশ মামলার
অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা
হয়েছে। এসব মামলায় এক হাজার ৫৩১
জন আসামির মধ্যে ৪৭৭ জনকে
গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা
হয়েছে। পরে তাদের অনেকেই
আদালত থেকে জামিন নিয়ে আবারও
পাচারের সঙ্গে জড়িয়েছে। একই
সময়ে পুলিশ পাচারের শিকার দুই
হাজার ৯৪৫ জনকে উদ্ধার করেছে।
Home »
কক্সবাজার
,
গডফাদারদের সামনে পেছনে
এমপি বদি
এস এম রানা
» গডফাদারদের সামনে পেছনে
এমপি বদি
এস এম রানা, কক্সবাজার
গডফাদারদের সামনে পেছনে এমপি বদি এস এম রানা, কক্সবাজার
Written By Unknown on শনিবার, ১৬ মে, ২০১৫ | ১১:২৫ PM
Related Articles
If you enjoyed this article just Click here Read Dhumketo ধূমকেতু, or subscribe to receive more great content just like it.
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন