অনলাইন ডেস্ক
সবেমাত্র এসএসসি পাশ করেছি। আদুরে আমরা চার ভাইবো্নের মধে আমি হলাম দ্বিতীয়। ততোদিনে বড় আপুর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। পালাবদলে এবার তাহলে আমার পালা, ‘বিয়ের পালা’। তবে প্রকৃতির বৈষম্যে আমি আজ অসহায়। তাই আমি বর্তমান থাকতেও পালা চলে গেলো ছোট বোনের কাছে। দুর্ভাগ্যবশত সেখানেও ‘বাঁধা’ হয়ে রয়লাম এই ‘আমি’। বোনটার বিয়ের কথা একদম পাকাপাকি। হঠাৎ বরপক্ষ থেকে কথা উঠল যে মেয়ের মেজো বোন তো ‘হিজড়া’। তার ছোট বোন বিয়ে করায় যদি উত্তরসূরিও ‘তাই’ হয়! এই আলোচনা বরপক্ষে বেশ জোরাল ঝড় তুললো আর বিয়েটাও সে ঝড়ে ভেঙ্গেই গেল। এই ‘আমি’ টা আসলে কে? সেই সিদ্ধান্তহীনতায় যেনো সকল বাঁধার শুরু আমার জীবনে।
এভাবেই নিজের কৈশোরের কথা বলছিলেন তৃতীয় লিঙ্গের নাদিরা খানম। আজ তার পরিচয় এ নতুন কিছু বিশেষণও যোগ হয়েছে যদিও। গত ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মোবাইল প্রতীক নিয়ে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৭ (১৮,২০ ও ২২ ওয়ার্ড) এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি। এর আগে যশোরের বাঘারপাড়া পৌরসভা এবং সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভাতেও সংরক্ষিত নারী আসনে তৃতীয় লিঙ্গের দুইজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকলেও, সিটি করপোরেশনে তিনিই প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থী।
সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড ৭ (১৮,২০,২২) নং ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। এই ওয়ার্ডে গাড়ি প্রতীক নিয়ে ফেরদৌসী বেগম ১৩৮৯৯ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। আর নাদিরা খানম মোবাইল প্রতীক নিয়ে ৭৫৫১ পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন। সাত হাজার পাঁচশো একান্ন টি ভোট পেয়েছেন। তার মানে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সাড়ে সাত হাজার মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন উচ্চশিক্ষিত নাদিরা। সাড়ে সাত হাজার মানুষের মনে ঠাই করে নিয়েছেন।
সামাজিকতার মুখোশে অসামাজিকতার শিকলে বাধা পেয়েও নাদিরা খানম নিজের জায়গা করে নিয়েছেন দ্বিতীয়তে। হয়তো ভোট যুদ্ধে হেরে গেছেন কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে ঠিকই জিতেছেন। সর্বোপরি জনগণের কাছে নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারার যুদ্ধে জিতে গেছেন ‘মানুষ’ নাদিরা খানম।
আদমজী জুট মিলসের প্রোডাকশন ম্যানেজার সিরাজুল ইসলামের চার সন্তানের মধ্যে নাদিরা দ্বিতীয়। তারা থাকতেন দিনাজপুরের নিউ টাউনের নিজ বাড়িতে। ছোট বোনের বিয়েতেও যখন সে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তখন তার নিজ বাবাকেই তার অপরিচিত ব্যক্তি বলে মনে হয়। পৃথিবীর সব থেকে নিষ্ঠুর মানুষ বলে মনে হয়। ‘এই সন্তানের জন্য কি আরেক সন্তানের জীবন নষ্ট হবে? একে বাড়ি থেকে বের করে দাও’ এই বলে মাকে চাপ দিতে থাকে বাবা। পরবর্তীতে মায়ের কষ্ট দেখে নিজেই বাড়ি ছেড়ে দিনাজপুরের পার্বতীপুর মামার বাড়িতে চলে যায় নাদিরা।
কিভাবে বাধা বিপত্তির মধ্যে থেকেও সমাজের অসামাজিকতার শিকলে আটকা পড়েও নিজের শিক্ষাজীবন চালিয়ে গিয়েছেন এর এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মামার এক বন্ধু ছিলেন নিঃসন্তান। তিনিই আমাকে সন্তান হিসেবে লালন-পালনের দায়িত্ব নিলেন। দিনাজপুর আদর্শ ডিগ্রি কলেজ থেকেই বিএ পাস করি। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগ থেকে এমএম পূর্বভাগে ভর্তি হই। ‘পালক বাবার’ সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ভাড়া বাসায় থেকে পড়াশুনা শেষ করি ১৯৯৯ সালে’।
উল্লেখ্য, রাজধানীতে মানবদরদী একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ইমু আপার কথা সবাই কমবেশি জানি। মানুষটি অন্যের বিপদের সময় নিজের সবটুকু দিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন। তবে সহযোগিতা করতে গিয়েও বাধার সম্মুক্ষীণ হন। একবারের ঘটনা তার মনে দাগ কেটে বসে আছে বেশ। ঢাকা মেডিকেল কলেজে এক মুমুর্ষ রোগির জন্য রক্ত দরকার। রক্তের যখন খুব অভাব, তখন এগিয়ে আসলো ইমু আপা। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতেও রোগীর বাড়ির লোক ইমু আপার রক্ত নিতে চাইছে না। তাদের ধারণা ইমু আপার রক্ত নিলে রোগীর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেউ হিজড়া হতে পারে। যে ধারণা সম্পুর্ণ ভুল। কারণ মেডিকেল ভাষ্যমতে হিজড়া হওয়ার জিন কারো রক্তের সাথে সম্পৃক্ত না।
সমাজের কুসংসার নিয়ে নাদিরা খানম বলেন, ‘কারো জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রেও যে সমাজ ভুল ধারণায় চোখ বন্ধ করে রেখেছে। তৃতীয় লিঙ্গের কারো রক্ত নিলে সে রক্তের মাধ্যমে রোগীর কিংবা রোগীর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেউ না কেউ ‘হিজড়া’ হয়ে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে আমি বলবো এরকম অন্ধত্বের কারণে আমার ভোট সহস্রে কমে গিয়েছে। মানুষ হিসেবে নয়, বরঞ্চ প্রকৃতীর কাছে হার মেনে ভোটে হেরে গিয়েছি আমি। তবে হয়তো মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছি সবার মনে’।
রংপুর নগরীর ২২ ওয়ার্ডের বালাপাড়ায় বসবাস করেন নাদিরা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিদের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে বর্তমানে ৩৭০ জন তৃতীয় লিঙ্গের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন এই মানুষ নাদিরা। তাদের নিয়ে কাজ করতে করতেই সমাজের মূল ধারায় কাজ করার তাগিদ অনুভব করেন বলেই সেই থেকেই চিন্তা থেকেই জনপ্রতিনিধি হওয়ার ইচ্ছা জাগে তার। তবে ভোটে হেরে গিয়েও আপেক্ষিক দিক বিবেচনায় জয় হয়েছে নাদিরা খানমের। এই জয় মানুষের, এ জয় মনুষত্বের।
বিডিটাইমস৩৬৫ডটকম/জেডএম
Home »
মানুষের ভালোবাসা পেয়ে কমিশনার হলেন ‘হিজড়া’ নাদিরা খানম
» মানুষের ভালোবাসা পেয়ে কমিশনার হলেন ‘হিজড়া’ নাদিরা খানম
মানুষের ভালোবাসা পেয়ে কমিশনার হলেন ‘হিজড়া’ নাদিরা খানম
Written By Unknown on সোমবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭ | ৫:৫৯ AM
Related Articles
If you enjoyed this article just Click here Read Dhumketo ধূমকেতু, or subscribe to receive more great content just like it.
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন