‘
যেমন চলছে কবরস্থানের বাসিন্দা লাখো মানুষের জীবন
আতাউর রহমান
২৮ ডিসেম্বর ২০১৭,বৃহস্পতিবার, ১৫:০৮
আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭,বৃহস্পতিবার, ১৫:০৮
টিভির সামনে বসা পরিবারের লোকজন। মজাদার দৃশ্য দেখে মাঝে মাঝে হেসে উঠছেন তারা। বাইরে একটি ছোট কফিন নিয়ে একটি বহর এলো মৃতকে কবরস্থ করার জন্য। বহরের নারীরা তাদের মৃত শিশুর জন্য কান্নাকাটি করছিলেন।
পাশেই একটি টিভিতে চলছিল মিশরের শীর্ষস্থানীয় দু’টি ক্লাব ইসমাইলি ও আল-আহলির মধ্যকার একটি ম্যাচ। জড়ো হওয়া লোকজনের ভিড় থেকে আহলির গোলগুলোর জন্য উল্লাসের শব্দ আসছিল।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
ওদিকে শিশুটির দাফনকার্যও চলছিল।
মিশরের রাজধানী কায়রোর ‘মৃতের শহর’ নামে পরিচিত এলাকার এটি একটি সাধারণ দিনের দৃশ্য। অন্য কবরস্থানের বাসিন্দাদের মতো এখানকার স্থায়ী বাসিন্দারাও যতটুকু সম্ভব স্বাভাবিক জীবনযাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এখানকার বাসিন্দা তিন সন্তানের জননী সাবরিন বলছিলেন, ‘এখানে বসবাস শুরুতে খুবই কঠিন মনে হতো। কিন্তু কিছু সময় পর আমরা এর সাথে নিজেদের মানিয়ে নিই। তখন এটা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।’
‘মাঝেমাঝে আমার মনে হয়, আমরা সবাই মৃত। কিন্তু আমাদের এখনো কবরস্থ করা হয়নি’, বলছিলেন তিনি। তার স্বামী সৈয়দ আল-আরাবির কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, আরাবির জন্ম এই কবরস্থানেই। ৬৭ বছর আরাবিরও ভয় তার বাবা-দাদার মতো তার ছেলেমেয়েদেরও হয়তো এ কবরস্থানেই জীবন পার করে দিতে হবে।
আল-আরাবি বলছিলেন, ‘এটা খুবই কঠিন ও দুর্বিসহ জীবন। আমি চাই না আমার সন্তানরাও এর ভুক্তভোগী হোক। তিনি জানান, তার স্ত্রী, ছেলের সাথে এখানে দুই ডিভোর্সি মেয়েরও স্থান হয়েছে।
আল-আরাবির ছেলে আহমেদ অনেকটা অনিচ্ছাকৃতভাবেই তাদের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলে। বলে, ‘আমরা আমরা এখানে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে বসবাস করছি। এ থেকে উত্তরণের কোনো উপায় নেই।’
১৩ বছর বয়সী আহমেদ জানায়, সে রাস্তার পাশের একটি খাবার দোকানে কাজ করে। এ থেকে তার দিনে মিশরীয় মুদ্রায় তার ৩০ টাকা (১.৬৮ ডলার) আয় হয়। এ দিয়ে সংগ্রাম করা পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছে সে।
‘অনেক মানুষ আসে এবং আমাদের ছবি, বক্তব্য নিয়ে যায় আমাদের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসবে বলে, তবে কাজের কাজ কিছুই হয় না। এমনকি আপনিও আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবেন না।’ মিডলইস্ট মনিটরের সাংবাদিককে বলছিল আহমেদ।
কফিন নিয়ে যেতে দেখছেন কায়রো গোরস্থানের এক বাসিন্দা
১৯৫০ সালে আল-আরাবির পিতা আবদেল হামিদ তার স্ত্রীকে নিয়ে কায়রোর দক্ষিণে ৩৫ কিলোমিটার দূরের গ্রাম থেকে কায়রো শহরে আসেন কাজের সন্ধানে। তবে একটি ছোট্ট বাসস্থানের ব্যবস্থাও করতে পারেননি তিনি। অবশেষে তাদের স্থান হয় আল-আজহার মসজিদের পাশে অবস্থিত প্রায় হাজার বছরের পুরনো একটি কবরস্থানে। এটি একটি ধনী পরিবারের নিজস্ব সম্পত্তি।
সমাজের বিখ্যাত লোকজনের শেষ ঠিকানা হিসেবে এ কবরস্থানটি বেশ পরিচিত। এখানে বিখ্যাত শিল্পী ও অভিনেতা ফরিদ আল-আত্রাশ ও তার বোন আসমাহানকে কবরস্থ করা হয়েছে।
এখানকার অধিবাসীরা কেউ কেউ কবরস্থানটির দারোয়ান, কেউ কেউ কাজ করছেন কবর খোঁড়ার। কেউবা ছোট দোকান খুলে বসেছেন। অন্য কিছু পেশায়ও কাউকে দেখা যায়।
২০০ বর্গমিটারের এ কবরস্থানটিতে রয়েছে একটি ছোট্ট দাফন ঘর। মিশরীয় ধনী পরিবারগুলো যাদের অনেক টাকা আছে তারা সাধারণত কবরের পাশে একটি ঘর কিনে থাকেন, যেখানে মৃতের জন্য দোয়া বা সম্মান জানানো হয়।
এ ঘরটি কেনার আরেকটি উপকারিতা হলো সপ্তাহান্তে বা বিশেষ ধর্মীয় দিবসে মৃতের পরিবারের লোকজন সেখানে গিয়ে মৃতের জন্য দোয়া করতে পারে এবং কিছু সময় সেখানে অবস্থান করতে পারে।
গরিবি হালতের ছোট্ট ঘরটিতে রয়েছে কিছু আসবাবপত্র এবং জীবনের কিছু চিত্র। পরিবারটির রয়েছে একটি অগোছালো বিছানা, দুটি বসার উপকরণ যা বিছানা হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। আছে পুরনো মডেলের একটি ওয়াশিং মেশিন ও একটি ছোট্ট টিভি।
ছোট্ট ও জরাজীর্ণ পাতিলে তৈরি হয় খাবার। বেশিরভাগ সময়ই তাদের খেতে হয় সাধারণ খাবার- ভাত, পাস্তা, আলু ও শিম।যেকোনো ধরনের গোশত তাদের পাতে খুব কমই পড়ে।
‘আমরা দিন এনে দিন খাই। তাই আমাদের অতিরিক্ত কোনো খাবার থাকে। আর সে কারণেই আমাদের কোনো ফ্রিজের দরকার হয় না’, বলছিলেন সাবরিন।
আল-আরাবির সাথে সাবরিনের যখন প্রথম দেখা হয় তখন তিনিও সেখানে তার বাবা-মায়ের সাথে বসবাস করছিলেন।
মিশরীয় জাতীয় পরিসংখ্যা সংস্থা ২০০৮ সালের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, শুধুমাত্র কায়রোর কবরস্থানেই ১৫ লাখ মানুষের বসবাস।
কিন্তু এর পর থেকে এ তথ্য আর হালনাগাদ করা হয়নি। ২০১৭ সালে দেশটির কেন্দ্রীয় জনসংযোগ ও পরিসংখ্যান সংস্থা সিএপিএমএএস জানিয়েছে, কবরস্থানে বসবাসকারীদের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। ৯ কোটি জনসংখ্যার দেশটির প্রায় ২ কোটিরই বসবাস রাজধানী কায়রোতে।
‘মৃতের শহরের’ আল ফারাহ গোরস্থানের বাসিন্দা উম ফাতিহ (৭০) শুকাতে দেয়া কাপড় খুলে নিচ্ছেন
আল-আরাবির পরিবার এক প্রতিবেশির ডিজেলচালিত একটি জেনারেটর থেকে বিদ্যুতের সংস্থান করেছে। এজন্য তাদেরকে মাসপ্রতি পরিশোধ করতে হয় ১০ থেকে ১৫ মিশরীয় পাউন্ড (০.৫৬ থেকে ০.৮৪ ডলার)।
কবরস্থানের বাইরে কিন্তু দাফন ঘরের কাছেই কাঠ দিয়ে বেড়ার মতো করে রাখা একটি গর্ত ব্যবহৃত হয় তাদের গোসলখানা হিসেবে।
২০১৭ সালে সরকারি এক হিসেবে বলা হয়েছে, ৪০ হাজারের মতো পরিবার সেখানে উপযুক্ত পায়খানা সুবিধা ছাড়াই সেখানে বসবাস করছে।
হতাশার স্বরে আল-আরাবি বলছিলেন, ‘২০১৭ সালেও আমরা এভাবে বসবাস করছি। পান করার উপযুক্ত পানি, বিদ্যুৎ ও অন্য জরুরি প্রয়োজনীয় চাহিদাও আমাদের মিটছে না।’
জুতা তৈরির কারিগর আল-আরাবির জমানো কোনো অর্থ নেই। তিনি জানান, তার কাজের চাহিদা খুব কমই। এ থেকে উপার্জনও খুব কম।
স্ত্রী সাবরিনের হৃদরোগের কথা জানিয়ে তিনি জানান, এ জন্য প্রতিমাসে প্রয়োজন পড়ে প্রায় ২৫০ মিশরীয় পাউন্ড (১৪ ডলার)।সৌভাগ্যক্রমে স্থানীয় একটি দাতব্য সংস্থা তার অপারেশনের ব্যয়ভার বহনের প্রস্তাব দিয়েছিল।
পাশের কবরস্থানে বসবাস ৬৩ বছর বয়সী হকার ইউনিস ইব্রাহিমের। তিনি শার্ট ও জুতা বিক্রি করেন। ‘আমি চোখ খোলা রেখে ঘুমাই’
৮ সন্তানের জনক ইব্রাহিম কবরস্থানের প্রধান দরজা কাঠের ফালি ও প্লাস্টিক ব্যাগ দিয়ে আটকিয়ে রেখেছেন। যাতে পরিবারের লোকজন রাতে ঘুমানোর সময় ঠাণ্ডা বাতাস থেকে রক্ষা পায়।
তিনি বলেন, ‘আমি আমার পরিবারের সুরক্ষার জন্য একটি দরজা চাই। আমি দুর্বৃত্তের ভয়ে চোখ খোলা রেখে ঘুমাই।’
ইব্রাহিম জানান, কবরস্থানকে ঘিরে দেয়া বেড়াটি নিচু। যেকোনো কিছু এর উপর দিয়ে লাফ দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়তে পারে।
পার্শ্ববর্তী সৈয়দা জয়নবে বসবাসকালীন ১৬ মাসের বাসা ভাড়া দিতে না পারায় ইউনুসের পরিবারকে ২০০০ সালে ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। এখন তারা বসবাস করছেন ৭ বর্গমিটারেরও ছোট্ট একটি ঘরে।
‘আমার আট ছেলে-মেয়ে রয়েছে। আমার বেতন ৫০০ পাউন্ডের (২৮ ডলার) বেশি হয় না। তাই আমার ঘরভাড়া ও প্রতিদিনকার অনেক চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না’, বলছিলেন তিনি।
‘ঘর ভাড়া খুব কম হওয়ায় আমরা এখানে এসেছি। আমাদেরকে এখন মাত্র ১০০ পাউন্ড (৫.৬ ডলার) দিতে হয়। এটা আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব হচ্ছে।’
তিনি এখন তার পরিবার ২০০০ সালে যখন এখানে আসেন তখন দারোয়ানকে প্রতিমাসে ৪০ পাউন্ড (২.২৪ ডলার) দিতে হতো। এর পর থেকে তা বেড়ে হয়েছে ১০০ পাউন্ড। কিছু দারোয়ান কবরস্থানগুলোকে অবৈধভাবে ভাড়া দিয়ে থাকে।
২০১৬ সালে সিএপিএমএএস ঘোষণা করেছে যে, মিশরের ২৭.৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। তাদের বার্ষিক আয় ৬ হাজার পাউন্ডের (৩৪০ ডলার) কম।
২০১৬ সালের নভেম্বরের পর থেকে ডলারের বিপরীতে মিশরীয় মুদ্রার দাম কমে যাওয়ার পর থেকে দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকে।
লোকাল টকশো উপস্থাপক আমর আদিবের দ্রব্যমূল্যে ছাড় দিতে উৎসাহিত করা সংক্রান্ত এক পোস্টারে শোভা পাচ্ছে ইউনিসের ছবি।
ইউনুস হেসে বলেন, ‘প্রত্যেকটি জিনিসই খুব ব্যয়বহুল।’ ইউনিস শব্দ দেখেন তার একটি ফ্ল্যাট হবে, যেখানে সুরক্ষিতভাবে বসবাস করবে তার পরিবার। যেকোনো স্থানে সেটা হতে পারে।
‘কিন্তু বিষয়টি খুব কঠিন। কিভাবে আমি ডাউন পেমেন্ট দিব? যদি ১০০ পাউন্ড (৫৬ ডলার) আয় করতে পারি, তাহলে আমি পরিবারের খাবার কিনতে পারি।’
কায়রোর রাস্তা সালেহ সালেমের অন্য প্রান্তে আল-ইমাম আল সাফিই কবরস্থান। সেখানে দুই কক্ষের একটিতে বসবাস করছেন ৪৫ বছর বয়সী মাহমুদ আল সাইদি। অন্য কক্ষটিতে বসবাস করছে আরেকটি পরিবার। সে কক্ষগুলোর পরিবার আনুপাতিক হারে বড়।
সাত সন্তানের পিতা সাফিই সেখানে অবস্থান করছেন ২০০৫ সাল থেকে। তখন তার মাসিক ভাড়া ছিল ৬০ পাউন্ড (৩.৩৬ ডলার), কিন্তু বর্তমানে তা দিতে হয় ১২০ পাউন্ড (৭ ডলার)।
‘যদি আমার অন্য কোথাও একটি ঘরের ভাড়া দেয়ার সামর্থ্য হয়, তবে আমি এখানে মৃতদের সাথে থাকবো না’, বলছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘শুরুতে এখানে বসবাস আমার জন্য খুব কঠিন ছিল। আমি ঘুমাতে পারতাম না এটা ভেবে যে, আমি মৃতদের সাথে শুয়ে আছি। পরে আমি উপলব্ধি করতে থাকলাম, আমরা সবাই মৃত।’
‘মৃতের শহরে’ এক ব্যক্তিকে সেভ করে দিচ্ছেন এক নাপিত
কায়রো সরকারের মুখপাত্র খালেদ মুস্তফা মিডলইস্ট আইকে বলেছেন, ‘সরকার বস্তি এলাকার বাসিন্দাদের আবাসনের ব্যাপারটি অগ্রাধিকারভিত্তিতে দেখছে।’ ‘আমার জীবনটা কবরস্থানেই কেটেছে’
কবরস্থানে কতজন লোক বসবাস করছেন তার সুনির্দিষ্ট কোনো চিত্র না দিয়ে তিনি বলেন, বস্তি এলাকার বাসিন্দাদের দক্ষিণ কায়রোর ‘আল-আসমারাত’ বা পশ্চিম আলেকজান্দ্রিয়ার ‘ঘাইত আল আনাব’-এর মতো স্বাভাবিক আবাসনের ব্যবস্থা করতে প্রকল্প নিয়েছে সরকার।
কবরস্থান এলাকার বাসিন্দাদের মাঝে এনজিও পরিচালনাকারী মেধাত বলেন, সরকার মিশরীয় সমাজের এ শ্রেণীর প্রতি নজর দিচ্ছে না। যেন এ লোকগুলোকে ভুলে গেছে।
মিশর সরকার উন্নতি ও পরিবর্তনের কথা বললেও এর কিছুই দৃশ্যমান হচ্ছে না।
স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম মাঝে মাঝে প্রতিবেদন করে থাকে যে, সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীরা এসব কবরস্থানকে তাদের কাজে ব্যবহার করছে।
‘এ মানুষদের শুধু দরকার স্বাভাবিক মানুষদের মতো স্বীকৃতি ও অধিকার’, বলেন মেধাত।
আল-আরাবি শেষ বক্তব্য ছিল, ‘আমি এ কবরস্থানে আমার জীবনের অতীত সময়টা পার করেছি, এখানে বিয়ে করেছি এবং সন্তানদেরও জন্ম হয়েছে এখানে। আর এখানে মৃত্যুও হতে চলেছে আমার।’
Home »
মৃতের শহর’-এর বাসিন্দা এক নারী
» মৃতের শহর’-এর বাসিন্দা এক নারী
মৃতের শহর’-এর বাসিন্দা এক নারী
Written By Unknown on শুক্রবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৭ | ১১:৫৫ PM
Related Articles
If you enjoyed this article just Click here Read Dhumketo ধূমকেতু, or subscribe to receive more great content just like it.
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন