উপেক্ষার অভিমানে হারিয়ে যাওয়া এক নক্ষত্র বাঁশখালীরই মেয়ে নভেরা আহমেদ - যার ছোঁয়ায় নির্মিত হয়
______________________________________________
বাঙালি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটির রূপকার নভেরা আহমেদ এবং হামিদুর রহমান দু’জনে। হামিদুর শহীদ মিনারের দেয়ালে ম্যুরাল করেন এবং মিনারের মূল স্থাপনার পরিকল্পনা নভেরার। যিনি ডিজাইনে ডিপ্লোমা ও ত্রিমাত্রিক শিল্প ভাস্কর্য বিষয়ে ডিগ্রি নিয়েছেন, তাঁর পক্ষেই সম্ভব মিনারের নকশা তৈরি করা। কারণ হামিদুর ম্যুরাল করলেও কখনো ভাস্কর্য গড়েননি। অথচ কোন এক সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের কারণে হামিদুর রাহমানই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের স্থপতির কৃতিত্ব লাভ করেন এবং নানা ঘটনা ও প্রতিকূলতায় শিল্পী নভেরা আহমেদ চলে যান আড়ালে।
এখনও সাধারণ জ্ঞানের বইতে আমরা শহীদ মিনারের ডিজাইনারের নামের জায়গায় শুধু হামিদুরের নামটি দেখতে পাই। অথচ আসল সত্য হল, শহীদ মিনারের ডিজাইন নভেরা এবং হামিদুর রহমান দু’জনে মিলেই করেছিলেন। আর এর পরিকল্পনা এসেছিল নভেরার ঝবধঃবফ ড়িসধহ নামের দুটি ভাস্কর্য থেকে। সেখানে মাতৃ প্রতিকৃতি ও আনত সন্তানের সম্পর্ক ছিল, যেটা শহীদ মিনারের মূল উপজীব্য। যদিও শহীদ মিনার পরিকল্পনায় নভেরার অবদানের বিষয়টি বিতর্কিত হয়ে গেছে, তবে তাদের যৌথ কাজের অনেক প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন এবং একসময়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেন তাঁরা।
প্রয়াত লেখক সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘হৃৎকলমের টানে’ সংকলনটিতে কয়েক জায়গায় উল্লেখ করেছেন প্রসঙ্গটি। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “হামিদুর রহমান চিত্রকর, ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পরিকল্পনাকারী শিল্পী দু’জনের একজন, অপরজন ভাস্কর নভেরা আহমেদ”। আরেক জায়গায় লিখছেন, “মনে পড়ে গেল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নকশা করেছিলেন যে দু’জন তাদের এক জনের কথা আমরা একেবারেই ভুলে গিয়েছি। প্রথমত আমরা একেবারেই জানি না এই মিনারের নকশা কারা করেছিলেন, যদিও বা কেউ জানি তো জানি শুধু শিল্পী হামিদুর রহমানের নাম, খুব কম লোকে চট করে মনে করতে পারে যে হামিদের সঙ্গে আরও একজন ছিলেন । হামিদের সঙ্গে ছিলেন বলাটা ভুল, বলা উচিত দু’জনে একসঙ্গে এই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের রূপটি রচনা করেছিলেন। অপর সেই ব্যক্তিটি হচ্ছেন নভেরা আহমেদ।"
সৈয়দ হক আবার লিখেছেন, “কিছুদিন আগে শিল্পী হামিদুর রহমান ঢাকায় এসে টিভিতে একটি সাক্ষাৎকার দেন, এ সাক্ষাৎকারে হামিদ নভেরার নাম করেননি। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা দফতরের একটি প্রামাণ্য চিত্রেও হামিদের বক্তব্য আমরা শুনেছি শহীদ মিনার সম্পর্কে, কিন্তু তাকে শুনিনি নভেরার কথা উল্লেখ করতে।” শিল্পী হামিদুর রহমান নভেরার নাম উল্লেখ করুন আর নাই করুন ইতিহাসই সাক্ষী দেয় নভেরা ছিলেন। ১৯৫৮ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি The Pakistan Observer এর প্রথম পাতায় শহীদ মিনার সম্পর্কিত খবর দিয়ে যে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় তার একটি বাক্য ছিল: …The memorial has been designed by Mr. Hamidur Rahman in collaboration with miss. Novera Ahmed….
স্থাপত্য ভাস্কর্যের মূল নকশার পরিকল্পনা যে নভেরা ও হামিদের যুগ্ম চিন্তার ফসল এটি ছিল একটি সহজ সত্য, অথচ অজানা কারণে সরকারি খাতায় নভেরার নাম না থাকায় শহীদ মিনারের নকশা পরিকল্পনায় তাঁর অবদানের কথা দেশের আপামর মানুষ জানতে পারেনি। ভাস্কর্যের নকশা পরিকল্পনায় ভাস্করের সহযোগিতা থাকবে না, এটি বাস্তবসম্মত কথা নয়।
এ প্রসঙ্গে রবিউল হুসাইন তাঁর ‘ভাস্কর্যে মুক্তিযুদ্ধ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “আমাদের দেশে স্থাপত্য ভাস্কর্যের সর্বপ্রথম উদাহরণ হচ্ছে শিল্পী হামিদুর রাহমান, ভাস্কর নভেরা আহমেদ এবং স্থপতি জাঁ দেলোরা কর্তৃক নকশাকৃত ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। "সেসময়ে জাঁ দেলোরা ছিলেন সরকারের স্থাপত্যবিষয়ক উপদেষ্টা। হামিদুর রহমান শহীদ মিনারের যে মডেল ও স্কেচ উপস্থাপন করেছিলেন দেলোরা তার স্তম্ভগুলোর মাপ পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন ।
নভেরার সমকালীন চিত্রশিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর বলেন, “শহীদ মিনারে তাঁর অবদান অনেক। নভেরার ডিজাইন থেকেই শহীদ মিনার নির্মাণ করেছেন হামিদুর রহমান। আমি নিজে দেখেছি হামিদুর রহমান ও নভেরা একসঙ্গে তাঁবু গেড়ে অবিরাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ করেছে। পরবর্তীকালে তাদের সম্পর্কের ইতি ঘটে, সেই সঙ্গে নভেরার নামটিও শহীদ মিনারের ইতিহাস থেকে মুছে যায়।”
ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আহমদ রফিক। তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং সত্য ঘটনার আলোকে গবেষণা ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনা করেছেন। প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণেরও তিনি অন্যতম কারিগর। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষীও। নির্মাণাধীন শহীদ মিনারে ছিল তাঁর নিত্য যাতায়াত। এক সাক্ষাৎকারে তিনি শহীদ মিনার নির্মাণে ভাস্কর নভেরার অগ্রণী ভূমিকার কথা জানান ।
আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের পথিকৃৎ নভেরা আহমেদই শহীদ মিনারের মূল ডিজাইনার। তাঁর করা ডিজাইন থেকেই স্থপতি হামিদুর রহমান এটি নির্মাণ করেছিলেন বলে মনে করেন ফ্রান্স-প্রবাসী শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনা ইসলামও। তিনি একটি সাক্ষাতকারে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেন, “আমি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলতে পারি, নভেরাই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ডিজাইনার। পূর্ব-পাকিস্তান গণপূর্ত মন্ত্রণালয় নভেরার যে নকশা থেকে কাজ শুরু করেছিল, সে নকশাটাও আমি উদ্ধার করেছি। সরকার বা নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের কেউ জানতে চাইলে আমি দেখাতে পারি।” সূত্র: টুয়েন্টিফোর ডটকম
এছাড়া আনা ইসলাম নভেরাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন। উত্তরে নভেরা বলেছিলেন, “হামিদ তো ভাস্কর নয়। সে কী করে ডিজাইন করে। আমি মিনারের একটি ছোট্ট মডেল করে দিয়েছিলাম। হামিদের কাছেই আমার করা ড্রইংসহ সমস্ত কাগজপত্র ছিল ।” শিল্প ও শিল্পী: জুলাই, ২০১৪
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক লালারুখ সেলিম বলেন, “আমি নভেরাকে নিয়ে গবেষণা করছি কারও প্রতি বিরূপ চিন্তা থেকে নয়। আমার প্রয়োজনে আমি তাঁকে নিয়ে কাজ করছি। সে কাজ করতে গিয়ে যতটুকু জেনেছি, নভেরার কাজের একটা অন্যতম বিষয় ছিল ‘মা ও শিশু’। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটিও কিন্তু সে চিন্তা থেকেই করা। একজন মা তার চার সন্তানকে আগলে রেখেছেন। এটা সমকালীন কোনো শিল্পীর ক্ষেত্রে ঘটতে আমি অন্তত দেখিনি। সে দৃষ্টিকোণ থেকেও বলা যায়, নভেরাই শহীদ মিনারের ডিজাইনার।”
সৃজনশীল মানুষেরা প্রচন্ড স্পর্শকাতর হন। শহীদ মিনার নির্মাণে নভেরার অবদানকে অস্বীকার করে এবং তৎকালীন সময়ে তার কাজের প্রতি, তার ব্যক্তিত্বের প্রতি যে বিরূপ মনোভাব দেখানো হয়েছে তাতে তিনি ভীষণভাবে অপমানিত এবং মানসিকভাবে আহত হয়েছিলেন। যে কারণে তিনি বেছে নিয়েছিলেন স্বেচ্ছা নির্বাসন। এড়িয়ে চলেছেন নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিও। এমনকি একবার পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় নতুন পাসপোর্টের জন্য যখন প্যারিসের বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়েছিলেন তখন একবারও বাংলায় কথা বলেননি নভেরা এবং বাংলা লিখতেও অপারগতা প্রকাশ করেন।
বিষয়টি থেকেই অনুমান করা যায়, কী প্রচন্ড মানসিক আঘাত পাওয়ার কারণে নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলেন তিনি। তা নাহলে, যে মানুষটি শহীদ মিনারের রূপকার তিনি বাংলা ভাষা বুঝবেন না বা বলতে পারবেন না তা কি কখনো হয়! তবে বাইরে দেশের প্রতি, দেশের মানুষদের প্রতি তার অভিমান থাকলেও ভিতরে ভিতরে ভীষণ দূর্বল ছিলেন তিনি দেশের প্রতি । তাইতো জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের পাসপোর্টটি আঁকড়ে রেখেছিলেন ফ্রান্সের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়ে।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশকে নিয়ে ভেবেছেন, এমনটাই জানা যায় তাঁর ঘনিষ্ঠজন চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিনের কথা থেকেও। তিনি জানান, তাঁর হৃদয়ে ছিল বাংলাদেশ। তিনি বাংলাদেশের শাড়ি ছাড়া আর কিছু পরতেন না। তাঁর চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্যে ছিল বাংলাদেশ। এর অনেক প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর অনেক কাজে। যেখানে টিয়া পাখি, কক্সবাজার ও সুন্দরবন সহ আবহমান বাংলার অনেক দৃশ্যের দেখা মেলে তাঁর চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্যে। চলনে, বলনে, কর্মে তিনি হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন দেশকে, দেশের ঐতিহ্যকে, প্রিয় মাতৃভূমিকে।
আনা ইসলামের কথা থেকেও জানা যায়, মৃত্যুর পূর্বে নভেরা বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে বসে ছবি আঁকতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি পাসপোর্ট নবায়ন করিয়েছিলেন। তিনি দেশে আসার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন, শারীরিকভাবে একটু সুস্থ হলেই দেশে ফিরে আসবেন। হাসনাত আবদুল হাই-এর ‘নভেরা’ উপন্যাস থেকেও জানা যায়, দেশে আসার জন্য তিনি মামা বি. আর নিজামকে চিঠি লিখেছিলেন একটা টিকেট পাঠানোর জন্য। তবে দেশে ফিরে আসা আর হয়নি নভেরার, তার পূর্বেই এ পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়েছে তাঁকে ।
সেই পঞ্চাশের দশকে যখন এদেশে শিল্পকলার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা কেবল মাত্র হাঁটি হাঁটি করছে, সে সময় একজন নারীর ভাস্কর হিসেবে বিকশিত হওয়া সহজ কথা নয়। নারী উপেক্ষিত হয়ে এসেছে চিরকাল, উপেক্ষিত হয়েছেন নভেরাও। তবে তাঁর ভাস্কর্য গুলো চিরকাল কথা বলে যাবে, বলে যাবে সময়ের চেয়ে অগ্রগামী, স্বাধীনচেতা, অসাধারণ এক নারী জন্মেছিলেন এদেশে, তাঁর নাম নভেরা। আমাদের ঐতিহ্যে, আমাদের শহীদ মিনারের স্মৃতিতে তিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন চিরকাল...।
শহীদ মিনার আমাদের গর্ব, আমাদের অহঙ্কার। শহীদ মিনার আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর এই স্থাপত্যের নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণে নভেরার অংশগ্রহণ ঐতিহাসিক ও বাস্তব সত্য। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, আছে তাঁর কর্ম। তাঁর প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন হওয়া এবং যথাযথ স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। আর তাই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের স্থপতি ও রূপকার হিসেবে হামিদুর রহমানের নামের পাশে আমরা নভেরা আহমেদের নামটিও দেখতে চাই। এছাড়া তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সুদূর প্যারিসের এক গ্রামে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি আঁকড়ে ছিলেন প্রিয় বাংলাদেশের পাসপোর্টটি। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানাবো, প্যারিস থেকে নভেরা আহমেদ-এর দেহটি ফিরিয়ে আনা হোক স্বদেশে।
যথাযোগ্য মর্যাদায় দাফন করা হোক তাঁর প্রিয় মাতৃভূমিতে ।
#হাবিব
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন