গত বছরের (২০১৪ সাল) ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ হঠাৎ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশী হস্তক্ষেপের ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু কঠোর কথাবার্তা বলেছেন, যা কিনা অনেকের মতে শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ‘দু’আনার মন্ত্রী’ আর রাষ্ট্রদূতকে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ ও ‘বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য’ ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করার বিষয়টিকে অনেকেই মনে করছেন আওয়ামী লীগের কোল্ডওয়ার যুগে প্রত্যাবর্তনের প্রচেষ্টা। আসলে আওয়ামী লীগ এখনো সত্তর দশকের প্রথমার্ধকে আঁকড়ে থাকতে চায়। কারণ, সেটাই হচ্ছে আওয়ামী লীগের সোনালি সময়। যে কারণে আওয়ামী লীগ কোনো বিষয়ে কথা উঠলেই ওই সময়ে ফিরে যায় এবং দুনিয়াকে ওই অবস্থান থেকেই বিচার করতে চায়। যদিও দুনিয়া আগের থেকে অনেক বদলে গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কি আসলেই দেশের রাজনীতিতে বিদেশী হস্তক্ষেপের বিরোধী? এই প্রশ্নের উত্তর, আওয়ামী লীগ যদি আসলেই দেশের রাজনীতিতে বিদেশী হস্তক্ষেপের বিরোধী হতো তাহলে তার উচিত ছিল নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলাদেশ সফরকারী ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের বিভিন্ন বক্তব্য ও তৎপরতার বিরোধিতা করা। কিন্তু তা দলটি করেনি। আওয়ামী লীগের এই অবস্থানদৃষ্টে মনে হতে পারে দলটি ভারতবান্ধব এবং যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী। আওয়ামী লীগ কি আসলেই যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে এর অতীত রাজনৈতিক তৎপরতার ইতিহাসে। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের কাছে শোচনীয় পরাজয় বরণ করার পরও গণসমর্থনহীন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ কেন্দ্রে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকেন এবং পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান। সে সময় তাদের বক্তব্য ছিল যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচন একটি ‘প্রাদেশিক নির্বাচন’ মাত্র, সে কারণে কেন্দ্রে মন্ত্রিসভার রদবদলের প্রয়োজন নেই। পাকিস্তানে তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিলড্রেথ কূটনৈতিক শালীনতা বিসর্জন দিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেন, পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনের ফলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় রদবদলের প্রয়োজন নেই। (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৩৮)। এই মন্তব্যের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলো প্রতিবাদ জানিয়েছিল কি না সে ব্যাপারে সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী সম্পাদিত বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ : প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও শ্যামলী ঘোষের আওয়ামী লীগ ১৯৪৯-১৯৭১ গ্রন্থে কোনো কিছু পাওয়া যায়নি।
এ দিকে ড. শ্যামলী ঘোষ তার ওই গ্রন্থে ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দেয়া একটি বিবৃতির কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, এনডিএফ তার ন্যূনতম কর্মসূচিকে যখন পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য দেশের পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য ইস্যুকে স্থগিত রাখার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে, তখন পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ঢাকায় দেয়া কথিত এক বিবৃতি দেশের উভয় অঞ্চলের রাজনৈতিক মহলে বেশ বড় রকমের আলোড়ন সৃষ্টি করে। ওই মার্কিন রাষ্ট্রদূত নাকি এ কথা বলেন যে, তিনি তার দেশ ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বৃহত্তর সহযোগিতার চেষ্টা করবেন আর আমেরিকানদের সাথে পূর্ব পাকিস্তানিদের বৃহত্তর সমঝোতা থাকা উচিত। তিনি বিশেষ করে বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানিদের আরো বেশি সংখ্যায় যুক্তরাষ্ট্র সফর করা উচিত। তিনি এ কথাও বলেন, য্ক্তুরাষ্ট্র বরাবরই পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ দেখবে এবং এ অঞ্চলে উন্নয়নকার্যক্রম গ্রহণের উদ্যোগকে উৎসাহিত করবে। পিপিএ এবং এপিপির খবরে বলা হয়, পাকিস্তান সরকার বিষয়টি গুরুতর বলে গণ্য করছে এবং একই খবরে কেন্দ্রীয় সরকারের যোগাযোগমন্ত্রীর বরাতে বলা হয়, প্রেসিডেন্টের মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে পারে। ওই সময়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বিবৃতিকে ‘গোলমেলে, দুরভিসন্ধিমূলক’ বলে অভিহিত করে বিরক্তি প্রকাশ করেন।
সামান্য ব্যতিক্রম বাদে বিষয়টি নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া ছিল লক্ষণীয়ভাবেই ভিন্ন। পশ্চিম পাকিস্তানে এমন মনোভাব লক্ষ করা যায় যে, যার সার বক্তব্য হলো : যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবির নেপথ্যে রয়েছে (পশ্চিমাঞ্চলে একে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী উদ্যোগ’ বলে অভিহিত করা হয়)। লাহোরের জেলা বার অ্যাসোসিয়েশন ও করাচি মুসলিম লীগের (কনভেনশন) মতো কিছু সংগঠন এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি অর্থনৈতিক সহযোগিতার কথিত প্রস্তাব দেয়ার জন্য এ বিবৃতির নিন্দা জ্ঞাপন করে এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহারের আহ্বান জানায়। এ দিকে পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন এবং ঢাকা জেলা বার অ্যাসোসিয়েশনের মতো সমিতি-সংগঠনগুলোর বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের বিশেষ প্রয়োজনের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ রাখার বিষয়টির প্রশংসা করা হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিকদের মধ্যে তৎকালে নিষ্ক্রিয় পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ আলী পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর জন্য মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সমালোচনা করেছিলেন। অবশ্য আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন। ওই সময়ে নিষ্ক্রিয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জহিরুদ্দিন বলেছিলেন, মার্কিন সরকার সব ক্ষেত্রে এ যাবৎ অবহেলিত পাকিস্তানের ‘পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নে সাহায্য-সহায়তা করার ব্যাপারে যে আগ্রহ ও উদ্বেগ ব্যক্ত করেছে, তা প্রশংসনীয়।’ তিনি আরো উল্লেখ করেন, যেখানে মার্কিন ও অন্যান্য সাহায্য-সহায়তার ৭০ শতাংশ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করার বিষয় অবিসংবাদিত, ‘সেখানে মার্কিন সরকার পাকিস্তানের পার্লামেন্টের ভেতরে-বাইরে সমালোচনার আলোকে যদি পূর্ব পাকিস্তানে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় সাহায্য-সহায়তা বিলিবণ্টন সমস্যার সমীক্ষার চেষ্টা করে থাকে’ তাতে দোষের কিছু নেই। তিনি আরো উল্লেখ করেন, পূর্ব পাকিস্তানের কথা কোনো বিবেচনায় না রেখেই পশ্চিম পাকিস্তানের বিশেষ বিশেষ প্রকল্পের জন্য সাহায্য চাওয়া হয়েছে। তার মতে, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বিবৃতির ব্যাপারে যে আপত্তি, তা ‘রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত, যা অনভিপ্রেত মনে করা যায়।’
গোটা বিষয়কে ‘চায়ের পেয়ালার তুফান’ হিসেবে বর্ণনা করে ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বিবৃতিকে যৌক্তিকতা দেয়ার প্রয়াস পায়। পত্রিকায় বলা হয়, সাহায্য-সহায়তা দাতাসংস্থা পাকিস্তান সরকার প্রণীত প্রকল্পের সম্ভাব্যতা ও বাঞ্ছনীয়তার বিষয়ে খোঁজখবর নেবে, সেটা নতুন কিছুই নয়। এ কাজ আগেও করা হয়েছে, তখন কোনো কথা ওঠেনি। পত্রিকায় ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, ‘যে কৃত্রিম উত্তেজনা’ সৃষ্টি করা হয়েছে তার মতলব মিশ্র। একটি মতলবের জন্ম সেই কট্টর মহল থেকে, যাদের ‘মার্কিন বিরোধিতা সাধারণভাবে তাদের পূর্ব পাকিস্তানের জন্য দরদের চেয়ে বেশি’ আর দ্বিতীয়টি তাদের ‘যেসব পূর্ব পাকিস্তানি তাদের প্রদেশের জন্য বরাবরই অর্থনৈতিক সুবিচারের দাবি জানিয়ে আসছে, তাদের যারা দাবিয়ে রাখতে চায়।’
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যের যে উদ্দেশ্যই থাকুক, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা সেটিকে পূর্ব পাকিস্তানের অভাব-অভিযোগ তুলে ধরার কাজে লাগিয়েছিলেন। (আওয়ামী লীগ ১৯৪৯-১৯৭১, পৃষ্ঠা- ৭৪ ও ৭৫)। এখানে একটি বিষয় পাঠকদের অবগতির জন্য উল্লেখ করা যেতে পারে, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ওই বিবৃতির পর ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্সের (পিআইডিই) পরিচালক নিযুক্ত হন আমাদের এ অঞ্চলের প্রফেসর নুরুল ইসলাম। তিনি তার বাংলাদেশ জাতি গঠনকালে এক অর্থনীতিবিদের কিছু কথা বইয়ে জানিয়েছেন, মার্কিন প্রতিষ্ঠান ফোর্ড ফাউন্ডেশনের বিদেশী অর্থনীতিবিদদের চাপেই তাকে পরিচালক নিযুক্ত করা হয় এবং ওইসব বিদেশী অর্থনীতিবিদ আঞ্চলিক ইস্যুগুলো বিশ্লেষণে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। ওই বই পড়ে বোঝা যায়, আইডিইর দেশী-বিদেশী অর্থনীতিবিদদের গবেষণালব্ধ তথ্য ও উপাত্ত বাঙালি অর্থনীতিবিদেরা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে সরবরাহ করতেন, যাতে তারা জনগণকে সংগঠিত করতে পারেন। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ৬ দফা পেশ করেন এবং পরবর্তীকালে ওইসব বাঙালি অর্থনীতিবিদ ৬ দফার ব্যাখ্যাদাতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
Home »
» বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশী হস্তক্ষেপের ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশী হস্তক্ষেপের ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
Written By Unknown on সোমবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫ | ২:২৮ AM
Related Articles
If you enjoyed this article just Click here Read Dhumketo ধূমকেতু, or subscribe to receive more great content just like it.
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন