মাসে সম্মানী হিসেবে ৩৫০০ টাকা পান।
তা দিয়ে আমাদের সংসার ভালই চলছে আলহামদু লিল্লাহ। বাসা ভাড়া বাবদ ২০০০ টাকা দেই। বাকি টাকা দিয়ে খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজন পুরন করি।
আমরা যেই বাসায় থাকি তাকে বাসা বললে ভুল হবে। একটা রুমে রাতে ঘুমাই। যেই রুমে ঘুমাই সেই রুমেই রান্না-বান্না করি।
কারন আমাদের পাশের রুমগুলোতে অন্যান্য পুরুষ ভাড়াটিয়াও আছে। তাদের সাথে পর্দা রক্ষার্থে সবার সাথে খোলামেলা রান্না না করে রুমেই রান্না করি।
একটামাত্র বাথরুম, যা সকল ভাড়াটিয়া ব্যবহার করে। আমাদের সুবিধা হলো আমরা যখন ফজরে উঠি তখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে!
আমরা ওযু-এস্তেঞ্জা সেরে রুমে এসে সকল কাজ রুমেই করি। রান্না করার কারনে রুমটা গরম হয়ে যায়। তবে এতে পর্দা রক্ষা করা যায় বলে কষ্টটাকে কষ্ট মনে হয় না।
আমাদের সেই ভাড়াকরা রুমে কোন খাট, তোষক, ফ্রিজ, সোফা, ফার্নিচার কিছুই নেই। শুধু একটা বালিশ- যাতে দুজনে ঘুমাই।
আর একটা কাঁথা ও একটি বিছানার চাদর। একটা প্লেট- যাতে দুজনে একসাথে খাবার খাই। আর একটা গ্লাস।
আজ ঈদের দিন। গতকাল মাদ্রাসায় পড়ুয়া আমার ছোট বোনটি ঈদের ছুটি পেয়ে আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে।
কুরবানি করবার মত ক্ষমতা আমাদের মোটেই নেই। মাঝে মাঝে আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনে না খেয়ে ঘুমিয়ে থাকি। আমরা দুজনই এভাবে না খেয়ে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি।
অভাবের সংসারে স্বামীর স্বল্প বেতনে দিনগুলো খুব সুখেই কাটছে। না খেয়ে থাকার কষ্ট কখনো হৃদয়ে অনুভুতও হয় নি।
স্বামীর কষ্টের বিষয়টি চিন্তা করে আমি একটি মেয়েকে আরবী পড়াই। সেখান থেকে মাসে ৫০০ টাকা দেয়। এটাও স্বামী নিজেই ঠিক করে দিয়েছেন।
আমার কাছে পড়ুয়া মেয়েটির অভিভাবক আজ বেতন দেওয়ার কথা বলেছিল। আমি বিকেলে সেই বেতনের জন্য বের হলাম।
সরাসরি বেতনটা নিতে তাদের বাসায় চলে গেলাম। যাওয়ার সময় আমার স্বামীর মোবাইলটা নিতে খুব জোরাজুরি করলাম, কিন্তু মোবাইল হারিয়ে যাওয়ার অযুহাত দিয়ে তিনি তা দিলেন না। অগত্যা আমার ভাংগা মোবাইলটা নিয়েই বের হলাম। বেতন পেয়ে আমি মনে মনে খুব খুশী।
আজ ঈদের দিন, কিন্তু আমাদের বাসায় গোস্ত দুরে থাক, অন্য কোন খাবারও নেই! তাই বেতনটা পেয়ে আমার খুশী আর ধরে না!
রাস্তার পাশে গোস্ত বিক্রি হচ্ছে দেখে বাসায় থাকা স্বামী আর ছোট বোনের কথা মনে পড়ে গেলো। এমন ঈদের দিনে না খেয়ে থাকবে?
এসব ভেবে ১কেজি গোস্ত নিলাম। কিছুটা কম দামেই পেলাম। প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে পড়াতে গেলেও টাকা বেঁচে যাওয়ায় আর সন্ধা হয়ে যাওয়ায় আজ একটা রিক্সা নিয়ে নিলাম।
মনে মনে আমি খুব খুশী। বাসায় গিয়ে রান্না করে সবাই একসাথে খাবো। সারাদিনের না খেয়ে থাকার বিষয়টি ভুলে বর্তমান নিয়েই পুলকিত হচ্ছিলাম।
রিক্সাওয়ালা খুব জোরে রিক্সা চালাচ্ছে। পথে পথে কুরবানিকৃত পশুর ময়লার স্তুপ। আমি ভাবনার জগতে হাবুডুবু খাচ্ছি।
হঠাৎ খেয়াল করলাম রিক্সাওয়ালা রিক্সা ভয়ানক জোরে চালাচ্ছে! ব্যাটারী চালিত সেই রিক্সা থেকে আমার পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা!
আরো খেয়াল করে মনে হলো- আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! সন্ধার আলো-আঁধারিতে আমি ভুল দেখছি না তো?
এমন ভাবনার মাঝেই রিক্সাওয়ালা একটা গলির মাঝে গিয়ে রিক্সা থামিয়ে দিলো। সাথে সাথেই কয়েকজন লোক হাজির!!
চারদিক থেকে তারা ঘিরে ধরলো। আমার কাছে থাকা ভ্যানিটি ব্যাগে রিক্সাভাড়া ছাড়াও আরো ৪০/৫০ টাকা মত ছিল।
একটানে ব্যাগটি নিয়ে নিলো। ব্যাগে ছিল সেই ভাংগা মোবাইল, সাথে গোস্তের থলেটিও নিল। অনেক অনুনয় বিনয় করলাম অন্তত গোস্তের থলেটি ফেরত দিতে।
তারা দিলো না। ব্যাগ হাতিয়ে পেলো- ৪০/৫০ টাকা আর ভাংগা একটি মোবাইল! যা পেয়ে তারা আরো বিরক্ত হলো।
রিক্সাওয়ালাকে বললো, ফকীরনি ধইরা আনতে কইছে ক্যাডা?! একজন তো রিক্সাওয়ালাকে মারতে উদ্দত হলো! বললো, এতদিনে মানুষ দেইখাও চিনতে পারোচ না?!!
তাদের একজন গোশতের থলেটি নিয়ে নিলো।
দামি কিছু না পেয়ে রাগে তারা আমার হাতে থাকা দু চারটাকার জিনিষগুলিই নিয়ে নিলো। তবে কেউ আমার গায়ে হাত দিলো না।
অনেক কাঁদলাম, গোস্তটা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য খুব অনুরোধ করলাম। কিন্তু তাদের মন গলাতে পারলাম না।
সন্ধা গড়িয়ে রাতে এশার আগে বাসায় পৌছলাম। বাসায় পৌছাতেই হাউ মাউ করে কান্নার গতি আরো বেড়ে গেলো।
স্বামী এবং ছোট বোন আমার অবস্থা দেখে পেরেশান হয়ে গেলো। আমার যবান দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিল না।
তাদেরকে শুধু এতটুকু বলতে পারলাম- শখ করে গোস্ত কিনেছিলাম- কিন্তু আসার সময় ছিনতাইকারী তা নিয়ে গেছে।
স্বামী বললেন, যা তাকদীরে নেই তা নিয়ে আফসোস করে কোন লাভ নেই। ওগুলো তাদের তাকদীরেই ছিল।
তিনি কথা তো সত্য বলেছেন, কিন্তু আমার মনকে তো বুঝাতে পারি না! স্বামী বললেন, দেখো! যদি আমার মোবাইলটাও যেত,
তাহলে সবার সাথে যোগাযোগ করার নাম্বারগুলোও যেত। স্বামির প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠলো।
আল্লাহ যা করেন বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন।
♦ আলোর বাতিঘর ♦
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন